সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: প্রয়াত তুলসীদাস বলরাম (Tulsidas Balaram)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বৃহস্পতিবার দুপুরে নীরবেই চলে গেলেন কিংবদন্তি ফুটবলার। ১৯৫৬ সালের অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দল চতুর্থ স্থান পেয়েছিল। সেই দলের সদস্য ছিলেন বলরাম। ১৯৬০ সালের অলিম্পিকেও দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। রোম অলিম্পিকে হাঙ্গেরি ও পেরুর বিরুদ্ধে গোল ছিল বলরামের।
তুলসীদাস বলরাম মানে ভারতীয় ফুটবলের দীর্ঘ এক ইতিহাস। একসময়ে চুনী গোস্বামী, পিকে ব্যানার্জির সঙ্গে এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হত বলরামের নাম। ভারতীয় ফুটবলের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বলা হত তাঁদের। চুনী-পিকে আগেই চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের প্রয়াণে গভীর দুঃখ পেয়েছিলেন বলরাম। তাঁদের তিন জনের সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলরাম একবার বলেছিলেন,”পিকে, চুনী ও আমার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। জাতীয় দলের হয়ে পিকে প্রথমবার খেলেছিল ১৯৫৫ সালের চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্টে। সেই টুর্নামেন্ট হয়েছিল ঢাকায়। আমার অভিষেক ঘটে ১৯৫৬ সালের অলিম্পিকে। আমরা একসঙ্গে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত খেলেছি।” দেশের হয়ে খেলার পাশাপাশি বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিতেও খেলেছিলেন এই ত্রয়ী। খেলার মাঠে এই তিন কিংবদন্তির দারুণ বোঝাপড়া ছিল। তার প্রতিফলন ঘটত খেলাতেও।
[আরও পড়ুন: কোহলির ঘরের মাঠে নামার আগে ফুরফুরে টিম ইন্ডিয়া, ফিট হলেই দলে শ্রেয়স]
বলরাম ছিলেন অকৃতদার। উত্তরপাড়ায় থাকতেন তিনি। বেশ কয়েকবছর ধরে তিনি নিজেকে প্রায় গৃহবন্দি করেই রেখেছিলেন। খুব একটা বাইরে দেখা যেত না তাঁকে। বলরামের মনে জমা হয়েছিল অভিমানও। কলকাতায় ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলতেন তিনি। লাল-হলুদ ক্লাবকে এনে দিয়েছিলেন সাফল্যও। গোল করতেন, গোল করাতে পারতেন। সেই বলরাম একবার বলেছিলেন, তাঁর মৃতদেহ যেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে না যায়। বলরামের এহেন মন্তব্য নিয়ে তীব্র আলোচনা হয়েছিল ময়দানে। অর্জুন পুরস্কার পেলেও পদ্মশ্রী সম্মান পাননি বলরাম। এর জন্য তাঁর মনে আক্ষেপও ছিল।
১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছিল ভারত। সেই টুর্নামেন্ট প্রসঙ্গে বলরাম একবার একটা মজার গল্প বলেছিলেন। একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলরাম বলেছিলেন, পিকে-র জন্যই তিনি এশিয়ান গেমসে খেলতে পেরেছিলেন। ওই টুর্নামেন্টের জন্য হায়দরাবাদে প্রস্তুতি শিবির বসেছিল। খেলোয়াড় নির্বাচনও হয় সেখানেই। চূড়ান্ত নির্বাচনের পরে কলকাতায় ফিরে আসেন ফুটবলাররা। জাকার্তা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন সবাই। এমন সময়ে ফ্লুয়ে আক্রান্ত হন বলরাম। অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বলরাম স্থির করেছিলেন, দলের সঙ্গে জাকার্তা যাবেন না। কারণ গেলেও খুব একটা লাভ হবে না। দলের হয়ে খেলতে পারবেন না। তাঁর পরিবর্তে বরং অন্য কাউকে নিয়ে যাওয়াই ভাল।
সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন বলরাম। সেই সময়ে এআইএফএফ-এর অন্যতম বড় কর্তা ছিলেন পঙ্কজ গুপ্ত। তিনি রহিম সাহেব, পিকে ব্যানার্জি এবং চুনী গোস্বামীর সঙ্গে মিটিং করেন। মিটিংয়ের বিষয়বস্তু ছিল বলরামের জায়গায় কি স্ট্যান্ড বাই নিয়ে যাওয়া হবে? সেই মিটিংয়ে পিকে বলরামের হয়ে গলা ফাটিয়েছিলেন। পিকে বলেছিলেন, ”বলরাম অসুস্থ। যদি ও মারাও যায়, তাহলেও ওর মৃতদেহ আমরা জাকার্তায় নিয়ে যাব। দলের দরকার বলরামকে। ওকে বিমানে তলুন।” ওই দলের অধিনায়ক ছিলেন চুনী গোস্বামী। তিনিও রাজি হন। তার পরের ঘটনা ইতিহাস। দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে ভারত সেবার সোনা জিতেছিল।
হায়দরাবাদের মানুষ হলেও এই শহরের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়েছিল বলরামের নাম। বলরামের প্রয়াণ কেবল একজন প্রবীণ ফুটবলারের মৃত্যু মাত্র নয়। বলা চলে এক যুগাবসান। যে যুগ বাংলার ফুটবলের স্বর্ণখচিত অতীতকে প্রতিনিধিত্ব করে।