অর্ণব আইচ: ‘সুইসাইডাল রোড’ বা আত্মহত্যার পথ। বলছেন এলাকার বাসিন্দারা।
সেই পর্ণশ্রী এলাকা, সেই বেচারাম চ্যাটার্জি রোড। একই রাস্তায় ১৮ ঘন্টার মধ্যে পর পর চার আত্মহত্যা। হয়তো পুরোটাই কাকতালীয়। কিন্তু ‘ভয়ঙ্কর হ্যালোইন নাইট’-এর দিন দুয়েকের মধ্যেই পর পর এই চার আত্মহত্যা (Suicide) ঘিরে আতঙ্কে ভুগছেন এলাকাবাসী। সামনেই আবার ভূত চতুর্দশী। তাই আতঙ্ক যেন আর জাঁকিয়ে বসেছে ওই পাড়ায়।
প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ একই এলাকা বা রাস্তার দু’পাশের বাড়ির তিনটি ঘটনায় চারজন কেন আত্মহত্যা করলেন? অবশ্য তদন্তের খাতিরে আত্মহত্যাগুলির কারণ খুঁজতে মাথা ঘামাতে হচ্ছে পুলিশকেও। সোমবার সন্ধ্যার পর থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বারবার পুলিশের গাড়ি ও পুলিশের শববাহী ভ্যান বারবার আসতে দেখে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে একই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে। কেউ বা বলছেন ঝাড়ফুঁক করবেন, কেউ বা ভাবছেন তুকতাকের কথা, আবার কেউ ভরসা রাখছেন বিজ্ঞানে।
[আরও পড়ুন : মিলল শীতের আমেজ, এক ধাক্কায় কলকাতার তাপমাত্রা কমল ২ ডিগ্রিরও বেশি]
প্রথম ঘটনাটি ঘটে সন্ধ্যা ৬টার পর। পুলিশ জানিয়েছে, শুধু একাকীত্বে ভুগে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ১৬ বছর বয়সের এক কিশোরী। বেচারাম চ্যাটার্জি রোডের বাসিন্দা ওই ছাত্রীর মা মারা যান চার মাস আগে। এর পর থেকে হতাশা গ্রাস করতে শুরু করে তাকে। এখানে একটি দোতলা বাড়িতে ওই পরিবারের বাস। ছাত্রীটির বাবা অফিসের কাজে বের হয়ে যান। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সারাদিন বাড়িতে একাই থাকত সে। আগে তার পড়াশোনা দেখাশোনা করতেন মা। গত কয়েক মাস ধরে অনলাইন ক্লাস চলছে তার। কিন্তু মাতৃহারা ওই ছাত্রীর ক্লাস করতে ভালো লাগত না। সারাদিন একাকীত্বে ভুগত সে। পুলিশের ধারণা, সেখান থেকেই তৈরি হয়েছিল মানসিক অবসাদ। শেষ পর্যন্ত সোমবার সন্ধ্যায় বাবা বাড়ি ফিরে দেখেন, শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ। দরজা খুলে দেখা যায়, সিলিং-এর সঙ্গে গলায় মায়ের কাপড়ের ফাঁস দিয়ে ঝুলছে ওই কিশোরী। খবর পেয়ে পর্ণশ্রী থানার পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়।
এর কয়েক ঘন্টা পর ফের এই একই রাস্তায় আসতে হয় পুলিশকে। কারণ রাত এগারোটা নাগাদ পুলিশের কাছে খবর আসে, আগের ঘটনাস্থলের কিছুটা দূরেই নিজের দোতলা বাড়ি ভিতরে গলায় গামছা দিয়ে ঝুলছেন জয়দেব চট্টোপাধ্যায় (৫০) নামে এক ব্যক্তি। জানা গিয়েছে, লকডাউনের পর থেকেই অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। তারই জেরে আত্মহত্যা করেন ওই ব্যক্তি। একই রাতে সেই পর্ণশ্রীর বেচারাম চ্যাটার্জি রোড ফের পুলিশ আর পুলিশের শববাহী গাড়িকে ঢুকটে দেখেন এলাকার বাসিন্দারা।
[আরও পড়ুন : পাহাড় পরিস্থিতি জটিল করছে সরকার, নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী-মোর্চার বৈঠক নিয়ে অভিযোগ বিরোধীদের]
পর পর দুটি আত্মহত্যা নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা আলোচনা শুরু করেছিলেন রাতেই। সকাল থেকে চায়ের দোকানে সেই একই আত্মহত্যার কথা। এই আলোচনাই উসকে দিল দুপুরের ঘটনাটি। দুপুরে বেচারাম চ্যাটার্জি রোডের বাসিন্দারা জানতে পারলেন, একই রাস্তায় একটি পোস্ট অফিসের অদূরে আত্মঘাতী হয়েছেন এক যুগল। ফের সেই পুলিশের গাড়ি, ফের শববাহী ভ্যান সেই একই এলাকায়।
এই বেচারাম চ্যাটার্জি রোডে দোকান রয়েছে পাড়ার বাসিন্দা দেবতোষ রায়ের। জানালেন, এলাকার মানুষের মুখে শুধু পর পর আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা। হঠাৎ তাঁদের এলাকায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একসঙ্গে এতজন আত্মঘাতী হলেন কেন, তা বুঝতে পারছেন না তাঁরা। একে অন্যকে বোঝাচ্ছেন, এতে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু স্পষ্ট প্রত্যেকেই ভীত। গৃহবধূ কল্যাণী দত্ত জানান, সামনে আবার ভূত চতুর্দশী। এই ক’দিন রাতে পরিবারের সবাই এক ঘরেই ঘুমোবেন। গরম লাগলেও বন্ধ রাখবেন জানালা। কয়েকজন নিজের বাড়ি একবার ওঝাকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন। অনেক গৃহবধূই স্বামীকে বলেছেন, বেশি রাত করে বাড়িতে না ফিরতে।
যদিও এলাকার যুক্তিবাদী মানুষরা জানাচ্ছেন, এই ঘটনা গুলি একেবারেই কাকতালীয়। কেউ যেন অহেতুক ভয় না করেন। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘটনাগুলি পর পর এক এলাকায় ঘটলেও প্রত্যেকটি আলাদা। একটির সঙ্গে অন্যটির কোন যোগাযোগ নেই। কেউ যদি অবসাদে ভোগেন, তিনি বা তাঁর পরিজনরা সঙ্গে সঙ্গে যেন ১০০ ডায়ালে পুলিশকে ফোন করেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবে পুলিশ।