shono
Advertisement

গণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা

সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়েও ফেডারেশনের ভোটে ক্ষমতা জাহির করতে ব্রিজভূষণ ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন।
Posted: 06:17 PM Dec 27, 2023Updated: 08:43 PM Dec 27, 2023

ফেডারেশনের নির্বাচন কমিটি থেকে ব্রিজভূষণকে সাসপেন্ড করেও ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ দেওয়া হল। আন্দোলনরত কুস্তিগিরদের আহত অহংবোধে ‘মিথ্যে’ প্রলেপ লাগানোর এই দৃষ্টান্ত দেখল দেশ। স্পষ্টত, লোকসভা ভোটের মুখে হরিয়ানা, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ জাট-ভূমিতে বিরূপ প্রচারের ঝুঁকি নিতে নারাজ কেন্দ্রীয় সরকার। কৃষক বিক্ষোভের রেশ এখনও তাজা। এর উপর জাট জাত্যভিমান আহত হলে পরিণতি মন্দ বই ভালো হবে না। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

সাপ ও লাঠির সম্পর্ক প্রসঙ্গে জনপ্রিয় প্রবাদ-প্রবচনটি সাপ মারা গেলেও লাঠি না ভাঙা নিয়ে। সারার্থ, কৌশলে কাজ হাসিল করতে হবে, যাতে কোনওরকম ক্ষতি না হয়। সাম্প্রতিককালের রাজনীতিতে বিজেপির চমৎকার এক উদাহরণ মেলে ধরেছে রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজে, মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং এবং ছত্তিশগড়ে রমন সিংয়ের মতো দিকপাল রাজনীতিকদের অস্তাচলে পাঠিয়ে। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ ওই ত্রয়ীকে সরাতে চেয়েছিলেন। সফলও হয়েছেন। আপাতত তিনজনের ‘বিষ দাঁত’ তাঁরা উপড়েছেন তিন রাজ্যে অনুগতদের মুখ্যমন্ত্রী করে।

আরও এক দৃষ্টান্ত এই উদাহরণের মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত। অবশ্যই তা কংগ্রেসের দিক থেকে। ওই তিন রাজ্যে বিজেপির বিষ দাঁত উপড়ে ফেলতে শতাব্দী প্রাচীন দল লাঠিতে তেল মাখাচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। অথচ কী বিপত্তি! ‘বিজেপি’ নামক বিষধরকে মারা তো দূরের কথা, আহতও করতে পারল না! বরং লাঠি ভেঙে নিজেরাই আহত হল। একেই বলে, সাপ মরল না, উল্টে লাঠি গেল ভেঙে। তৃতীয় নমুনাও সাপের না মরা ও লাঠিরও না ভাঙা নিয়ে। ব্যাপারটা এমন, সাপ ফণা নামিয়ে সাময়িক খ‌্যামা দিল, ঘাতকের লাঠিও অক্ষত রইল। কুস্তিগিরদের আন্দোলন, কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচন, ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের সদর্প আস্ফালন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ নিয়ে এই কদিন যা ঘটল, তা মোটামুটি এর সঙ্গে তুলনীয়।

ফেডারেশনের নির্বাচনে ব্রিজভূষণকে ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ করে দিয়ে তাঁর ইগো প্রশমিত করা হল, আবার নব-নির্বাচিত কমিটিকে সাসপেন্ড করে আন্দোলনরত কুস্তিগিরদের আহত অহংবোধে প্রলেপ লাগানোর সুযোগও করে দেওয়া হল। নব-নির্বাচিত কমিটি যাতে আদালতে যেতে পারে, সরকার সেই সুযোগও তাদের জন্য খুলে রেখেছে। এইভাবে যুযুধান দুই পক্ষের ক্ষোভ প্রশমিত করে ভারতীয় রাজনীতির রাম-লক্ষ্মণ জুটি যা করলেন, তাকে ‘আপাত শান্তি স্বস্ত্যয়ন’ বলা যেতে পারে।
চাণক্যর এই চাল কেমন একটু খতিয়ে দেখা যাক।

[আরও পড়ুন: ‘কৃবু’, ‘নবু’, না ‘এআই’?]

এতকাল ধরে বিজেপি ও সরকার সমালোচিত হচ্ছিল, যৌন হেনস্তার এত মারাত্মক অভিযোগ সত্ত্বেও ব্রিজভূষণকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, দল থেকে তাড়ানো হচ্ছে না, কেন পুলিশকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে না ইত্যাদি নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী সমালোচিত হচ্ছিলেন তাঁর ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগানের করুণ পরিণতির দরুন। বিজেপির গঠনতন্ত্র ও আরএসএসের অভিধানে নারী যে সত্যিই ‘মর্যাদাহীন’, সেই আলোচনাও তুঙ্গে উঠেছিল। সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়েও ফেডারেশনের ভোটে ক্ষমতা জাহির করতে ব্রিজভূষণ ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন। সরকার চোখ বন্ধ করেছিল। তাঁকে তাঁর এলেম দেখানোর সুযোগ করে দিয়ে, শেষবেলায় ক্রীড়ামন্ত্রী তেড়েফুঁড়ে মাঠে নামলেন যখন ক্রন্দনরত সাক্ষী মালিক অবসর গ্রহণের ঘোষণা করলেন ও বজরং পুনিয়া, গুঙ্গা পালোয়ান, বীজেন্দ্র সিংয়েরা ‘পদ্মশ্রী’ খেতাব ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন (মঙ্গলবার, এই লেখা যখন ছাপা হতে চলেছে, খবর এল, ভিনেশ ফোগত ‘রাজীব গান্ধী খেলরত্ন’ ও ‘পদ্মশ্রী’ ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন)। স্পষ্টতই, লোকসভা ভোটের মুখে হরিয়ানার পাশাপাশি রাজস্থান, পাঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ জাট-ভূমিতে বিরূপ প্রচারের ঝুঁকি বিজেপি নিতে নারাজ। কৃষক বিক্ষোভের রেশ এখনও মেলায়নি। এর উপর কুস্তি নিয়ে জাট জাত্যভিমান আহত হলে পরিণতি অন্যরকম হতে পারে। চাণক্যতুল্য কৌশলটা এমনি এমনি নয়।

কমিটি সাসপেন্ড করার পক্ষে ক্রীড়া মন্ত্রকের দেখানো অনেক যুক্তির একটি হল, অভিযুক্ত ব্রিজভূষণের লোকজনের হাতেই ফেডারেশনের ভার গিয়েছে এবং সভাপতি সঞ্জয় সিং প্রতিদ্বন্দ্বিতারই উপযুক্ত নন। কারণ, চার বছরের তিনটি মেয়াদ তিনি ইতিমধ্যেই পূর্ণ করেছেন। এটাই কৌশল। এমনটা যে হতে চলেছে, সরকার তা ভোটের তোড়জোড়ের আগে থেকেই জানত। নির্বাচন তো আদৌ গোপনে হয়নি? তাহলে ভোটের আগেই সরকার কেন পদক্ষেপ করল না? উত্তর রয়েছে ব্রিজভূষণের ইগো সন্তুষ্টিকরণের মধ্যে। সেই সঙ্গে সরকার এ-ও বোঝাতে চাইল, যা করা হয়েছে তা আইন ও সংস্থার বিধি মোতাবেক। কমিটি মামলা করলে হার-জিত অন্য কথা।

এতে বিজেপির লোকসান নেই বিন্দুমাত্র। তারা অ্যাড হক কমিটি গড়তে বলেছে ‘ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোশিয়েশন’ (আইওএ)-কে। এই সংস্থার সভাপতি পি. টি. উষা। আন্দোলনরত কুস্তিগিরদের সঙ্গে ধরনাস্থলে গিয়ে দেখা করলেও যৌন হেনস্তার প্রতিবাদে তিনি কিন্তু সরব হননি। নারী ক্রীড়াবিদদের অসম্মান, অপমান ও যৌন হেনস্তা তাঁর বিবেককে দংশায়নি। দাবি মানার পরামর্শও তিনি সরকারকে দেননি। পদত্যাগের বাসনা প্রকাশ তো দূরের কথা, এমনকী, প্রকাশ্যে প্রতিবাদীও হননি! ধরনাস্থলে তিনি গিয়েছিলেন সরকারের তরফে মিটমাটের প্রস্তাব নিয়ে। কুস্তিগিররা তা প্রত্যাখ্যান করেন। একটি মন্তব্যও তাঁকে করতে শোনা যায়নি যা দিয়ে বোঝা যায় তাঁর শিরদাঁড়া ঋজু। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়ায় সরকারও তাই নিরাপদ।

সরকার জানে, অন্তত লোকসভা ভোট হওয়া পর্যন্ত নতুন করে বেইজ্জত হতে হবে না। গোটা ঘটনার মধ্য দিয়ে ‘নতুন ভারত’-এ বিজেপির চরিত্র আরও প্রস্ফুটিত হল। গত দশ বছরে জনপ্রিয় আন্দোলন কম হয়নি। রাজনৈতিক দাবিও কম ওঠেনি। সংসদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধীরা সরব হয়েছে। কিন্তু কৃষক আন্দোলন বাদ দিলে এমন আর একটি ক্ষেত্রও নেই যেখানে আন্দোলনের চাপে সরকার নত হয়েছে। কত বিল পুনর্বিবেচনার জন্য স্ট্যান্ডিং কমিটি বা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি উঠেছে। সরকার মানেনি। কত বিলের বিতর্কিত ও অন্যায্য ধারা সংশোধনের অনুরোধ হয়েছে। সরকার কর্ণপাত করেনি। দশ বছরে একবারের জন্যও লোকসভা বা রাজ্যসভায় কোনও মুলতবি প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। একটি ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীকে বাধ্য করা যায়নি বিবৃতি দিতে। অতীতে বহুবার লোকসভার স্পিকার ট্রেজারি বেঞ্চকে বিবৃতি দিতে বাধ্য করেছেন। মোদির নতুন ভারতে একবারও তেমন ঘটেনি। তা সে গালওয়ানে চিনা আগ্রাসন ও সেনানিধন, লাদাখে জবরদস্তি জমি দখল, ডোকলাম সংঘর্ষ, বেকারত্ব, বেহাল অর্থনীতি, মণিপুর অথবা আদানি।

[আরও পড়ুন: নীরব একাকিত্বের উৎসব]

প্রসঙ্গ যাই হোক, বিরোধীরা মাথা খুঁড়ে মরলেও দাবি মেনে সরকার সংসদের মর্যাদা রক্ষা করেনি। ব্রিজভূষণকে যেভাবে রক্ষা করছে, সেইভাবে লখিমপুর কাণ্ডে (গাড়ি চাপা দিয়ে কৃষক হত্যা) অভিযুক্তর বাবা স্বরাষ্ট্র-প্রতিমন্ত্রী বাবা অজয় মিশ্রর সামনেও ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে মোদি সরকার। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছে সংসদ হামলা। বিরোধীদের সমস্বর দাবি একটাই, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিবৃতি। তা না-মেনে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকার নজির সৃষ্টি করে গর্ববোধ করছেন দুই কক্ষের দুই কান্ডারি– ওম বিড়লা ও জগদীপ ধনকর। ১৪৬ জন সংসদ সদস্যর বহিষ্কার ভারতীয় গণতন্ত্রর চরম লজ্জা। সেই লজ্জা ঢাকতে নির্লজ্জর মতো টেনে আনা হচ্ছে ‘মক পার্লামেন্ট’-এ রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের অঙ্গভঙ্গি নকল করার মতো অকিঞ্চিৎকর বিষয়। আসল অপরাধ ঢাকতে নকলকে হাতিয়ার করার শিল্প বিজেপির কাছ থেকে বিরোধীদের শিখতে হবে।

অবাক লাগে যখন দেখি অসম্মানের অভিযোগ তারা তুলছে, যে দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী দিনের পর দিন বিরোধী নেতাদের সংসদের কক্ষে ও বাইরে বেলাগাম অপমান করে গিয়েছেন! সোনিয়া গান্ধীকে বলা হয়েছে ‘জার্সি গরু’ ও ‘কংগ্রেসের বিধবা’। রাহুলকে ‘হাইব্রিড বাছুর’। রাজীব গান্ধী ‘কোরাপ্ট নং ১’। মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী ‘মৌনি বাবা’ বলে ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘উনি রেনকোট পরে স্নান করেন!’ রেণুকা চৌধুরীকে বলা হয়েছিল ‘শূর্পণখা’, শশী থারুরের স্ত্রী সুনন্দা পুষ্করকে ‘৫০ কোটির বান্ধবী’। দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রেয়াত করেননি তিনি। ‘দিদি ও দিদি’বলে ভেঙিয়েছেন! রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের চিঠির প্রত্যুত্তরে কংগ্রেস সভাপতি লিখেছেন, সরকারকে সংসদে দায়বদ্ধ না করার জন্য ইতিহাস একদিন চেয়ারম্যানের সমালোচনা করবেই। তখন তা দুঃখজনক হবে। ভাবছি, ভারতীয় গণতন্ত্রর অন্তর্জলি যাত্রা যেভাবে গতিপ্রাপ্ত, তাতে ভবিষ্যতে প্রকৃত ইতিহাসবেত্তার সন্ধান পাওয়া যাবে কি?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement