প্রীতিকা দত্ত: ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে শেষ কবে নীল আকাশটা দেখেছেন, মনে পড়ে? ইনস্টাগ্রামে ছবি পোস্ট করার জন্য নয়, স্রেফ চোখের আরামের জন্য? বা ধরুন, কিন্ডল ভুলে প্রাণ ভরে শেষ কবে নতুন বইয়ের গন্ধ উপভোগ করেছেন? মনে করে দেখুন, শেষ কবে রাতের রাস্তায় লং ড্রাইভে বেরিয়েছেন? মনে পড়ছে না, তাই তো? বিজ্ঞান বলছে, টেক্সট মেসেজ বা একটা ‘লাইক’-এ আমাদের শরীরে ছড়াতে থাকে ‘ডোপামিন’ নামে কেমিক্যাল। অ্যালকোহল বা সিগারেট খেলে যে সুখ পাওয়া যায়, একই সুখ আমরা পাই এই ডোপামিনের দৌলতে। আর হ্যাঁ, মদ্যপান বা সিগারেটের মতো এই স্ক্রিন-প্রেমও এক ধরনের নেশা। অ্যাডিকশন। যে অসুখের প্রেসক্রিপশন ডিজিটাল ডিটক্স।
কী এই ডিজিটাল ডিটক্স?
সহজ বাংলায় বললে দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় সব রকম গ্যাজেট ভুলে, অফিস-বাড়ির চাপ ভুলে জাস্ট নিজের জন্য বাঁচা। ল্যাপটপ, স্মার্টফোনের বদলে এই সময়টা আপনার সঙ্গী বন্ধু বা পরিবারের কাছের মানুষ। যাকে বলে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানো। ডিজিটাল দুনিয়ার কবল থেকে বেরোতে কেউ কেউ আবার চলে যাচ্ছেন আশ্রমে। বা পুণের ‘আত্মনতন’-এর মতো ওয়েলনেস রিসর্টে। কারও আবার পছন্দের টোটকা এমন কোনও জায়গায় বেড়াতে যাওয়া, যেখানে মোবাইল ‘আউট অফ নেটওয়ার্ক এরিয়া’।
কখন দরকার?
যখন রোজকার যাপনে বা দরকারি কাজের জায়গাগুলো নিয়ে নেয় নেটফ্লিক্স সিরিজ বা ইউটিউব ভিডিও। অথবা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম দেখে কেটে যায় আপনার সারা দিন। যখন নেশা এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, বারবার ডেটলাইন মিস করছেন। স্টুডেন্ট ভুলে বসছে পরীক্ষার তারিখ।
[ ফাঁস হল ছ’টি ক্যামেরা-যুক্ত স্যামসং Galaxy S10-এর ছবি ]
নো-টেক জোন
ডিজিটাল ডিটক্সের প্রথম স্টেপ বাড়িতে একটা নো-টেক জোন তৈরি। হাতের কাছের গ্যাজেট যেমন ফোন, কিন্ডল, ভিডিও গেম, ল্যাপটপ আর যা যা আছে সব কিছুর একটা লিস্ট বানিয়ে নিন। আর মনস্থির করুন, আপনার নো-টেক জোনে সেগুলোকে কিছুতেই ঢুকতে দেবেন না। প্রথমেই সাকসেসফুল হবেন এমন গ্যারেন্টি নেই। কিন্তু চেষ্টা করলে সব সম্ভব। যেমন অভিনেতা আবির চট্টোপাধ্যায়। সকালে শুটিংয়ে যেতে দেরি হবে, এই ভেবে ফোনে এখনও পর্যন্ত নেটফ্লিক্স ডাউনলোড করেননি। “নেটফ্লিক্সের কনটেন্ট দারুণ। ল্যাপটপে রাত জেগে মাঝে মধ্যে দেখি। কিন্তু এর চেয়ে বেশি হলে প্রবলেম। তাই ফোনে নো নেটফ্লিক্স,” বলছিলেন আবির।
গোলপোস্ট ছোট করুন
ফোন থেকে নিজেকে দূরে রাখুন বললেই তো আর কাজটা করা যায় না। প্রথমেই ‘টানা এক সপ্তাহ ফোন দেখব না’ বললে নিজেরই মুশকিল বাড়বে। তাই শুরুর দিকে নিজের সামনে ছোট ছোট লক্ষ্য রাখুন। যেমন ‘সকালের চা না খাওয়া পর্যন্ত ফেসবুক চেক করব না’ বা ‘জরুরি মিটিংয়ের দিন নো ইনস্টাগ্রাম’।
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টিপস: “সারাদিন যতই ব্যস্ত থাকুন, নিজের জন্য দশ মিনিট হলেও সময় বের করুন। সব সময় ইন্টারনেটে মুখ গুঁজে বসে থাকায় কাজের থেকে অকাজ হয় বেশি। ওই দশ মিনিটে বাইরের জগতটা দেখুন, জানুন। বই পড়ুন। পরিবারকে সময় দিন। সেই সঙ্গে নিজের ফ্রি সময়টাকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিতে শিখুন।”
ডিটক্স গোল সেট করা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য ঘড়িতে অ্যালার্ম দিন। মোবাইলে নয়। খেতে খেতে মোবাইল চেক নৈব নৈব চ। এতে স্ক্রিন অ্যাডিকশনের সঙ্গে সঙ্গে বেশি খেয়ে ফেলার আশঙ্কাও থাকে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফোন দূরে সরিয়ে রাখুন। অফিসে বা কলেজের লাঞ্চটাইমে ডেস্কে না বসে থেকে অন্যদের সঙ্গে গল্প করুন। উইকএন্ড বা ছুটির দিনে বন্ধুদের সময় দিন। এই সময় যেন কোনও ভাবেই আপনাদের জীবনে মোবাইল হানা না দেয়।
মি টাইম
ডিজিটাল নেশা সাময়িক কাটানোর সবচেয়ে সহজ উপায় শপিং বা পার্লারে প্যাম্পারিং সেশন। বিউটি অ্যান্ড হিলিং এক্সপার্ট ঝিলম বোস বিশ্বাস শুধু মনে করিয়ে দিলেন, “হেড ম্যাসাজ নেওয়ার সময় মোবাইলটা সুইচ অফ করে রাখবেন প্লিজ। না হলে মনটা ওই ফোনের দিকেই থাকবে।” তা ছাড়া নিজের জন্য সারা দিনে যে দশ মিনিট সময় দিচ্ছেন, তখন মেডিটেশন করতে পারেন। এ সবেও কাজ না দিলে ভেবে দেখুন ওয়েলনেস রিসর্টের কথা। এ সব রিসর্টে তিন থেকে সাত দিনের প্যাকেজ পাওয়া যায়। তবে তা বেশ খরচসাপেক্ষ।
ডিটক্স বাডি
অনেক কঠিন কাজও সহজ হয় মনের মতো সঙ্গী পেলে। বিশেষজ্ঞরা তাই সবার আগে একজন ‘ডিটক্স বাডি’ খুঁজে নিতে বলছেন। এই লিস্টে বন্ধুরা সবচেয়ে হেল্পফুল। না হলে পরিবারের কেউ।
সঙ্গী যখন কারভাঁ
গান শোনা যদি আপনার নেশা হয়, তাহলে কিনতে পারেন সারেগামার কারভাঁ। হাজার ছয়েক টাকার এই যন্ত্র যে কোনও নেশা কাটানোর মোক্ষম দাওয়াই। কিশোর-রফি-মুকেশ-আর ডি-অরিজিৎ সিং, এখানে পেয়ে যাবেন সবাইকে।
ইন্ডোর গেম
মোবাইল গেমিং নয়। ফ্রি-টাইমে খেলতে পারেন দাবা, মোনোপলির মতো বোর্ডগেম। আর সামনেই শীতকাল। মানে পাড়ার ক্লাবে ব্যাডমিন্টন বা ভলিবল টুর্নামেন্ট। এ বার আর দর্শকাসনে নয়, কোর্টে নেমে পড়ুন। মোবাইল মোহ কমবে। ফিটনেস বাড়বে। যাকে বলে উইন-উইন সিচুয়েশন।
[ বাজেট ৭ হাজার টাকা? বেছে নিতে পারেন এই স্মার্টফোনগুলি ]
ডিটক্স ট্যাবলেট
- সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য মোবাইলে নয়, ঘড়িতে অ্যালার্ম।
- খেতে খেতে মোবাইল চেক করবেন না।
- অফিসে বা কলেজের লাঞ্চটাইমে অন্যদের সঙ্গে গল্প করুন।
- ঘুমোনোর সময় বালিশের পাশে নয়, ফোন রাখুন দূরে।
- জিম করা শুরু করতে পারেন।
- সঙ্গীর সঙ্গে নেটফ্লিক্স দেখুন। তাতে বিঞ্জ ওয়াচিংয়ের ঝুঁকি কম।
- পছন্দের বই পড়া শুরু করুন।
The post মোবাইলের মোহ কাটাতে বন্ধু তৈরি করুন appeared first on Sangbad Pratidin.