সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: সন্ধের পর থেকেই শোওয়ার ঘরের জানলা খুললেই কানে আসছে মহিলার কান্না। হলঘর থেকে শোনা যাচ্ছে বেঞ্চ টানার শব্দ। মাঝরাতে মনে হচ্ছে, ছাদের উপর কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। অন্ধকার নামার পর থেকে এমন সব ভূতুড়ে কাণ্ডে কাঁটা পুরুলিয়ার (Purulia) ওই হস্টেলের ছাত্রীরা। আতঙ্কে জেগে কাটাচ্ছে রাতের পর রাত। কেউ কেউ হস্টেল ছেড়ে চলেও যাচ্ছে। দু’জন ওয়ার্ডেন ছাড়া বাকি কর্মীরাও রাতে হস্টেলে থাকতে চাইছেন না। পুরুলিয়ার কাশিপুর গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী নিবাসের এমন ঘটনায় মাথায় হাত স্কুল কর্তৃপক্ষের।
গত সাতদিনের বেশি সময় ধরে এমন সব ভৌতিক কাণ্ড ঘটায় শেষমেশ স্কুল কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞান মঞ্চের দ্বারস্থ হয়। তবু ছাত্রী নিবাস থেকে ভূতের আতঙ্ক কাটছে না। পরিস্থিতি এমনই যে কার্যত হোস্টেল খালি হতে বসেছে। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মিতালী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ” ছাত্রীরা ভয় পেয়েছে তাই এই ঘটনা ঘটেছে। বিজ্ঞান মঞ্চ এসে কুসংস্কার বিরোধী প্রচার করে গিয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর সেভাবে ভয়-আতঙ্ক নেই ছাত্রীদের মনে।”
[আরও পড়ুন: ‘কোনও DA বকেয়া নেই’, পুজোর অনুদান মামলায় হলফনামা রাজ্যের]
প্রধান শিক্ষিকা এমন কথা বললেও বাস্তব ছবি কিন্তু ঠিক তার উলটো। প্রতিদিন এক-এক করে ছাত্রী যেমন হোস্টেল ছাড়ছে, তেমনই সন্ধ্যে নামার আগেই হস্টেল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন কর্মীরা। ছাত্রীদের কথায়, “আমাদের যেখানে বেডরুম সেখানকার দরজা-জানলা খুললেই রাতের বেলায় মহিলার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। সেই সঙ্গে অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে। সেসব কথা বলতে গেলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। আর বোধহয় এই হস্টেলে থাকতে পারব না।” এক ছাত্রীর কথায়, “এই তো কদিন আগে হল ঘর থেকে বেঞ্চ টানার শব্দ শুনছিলাম। অত রাতে বেঞ্চ কে টানবে বলুন তো? সাহস করে হল ঘরে গিয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই। শোওয়ার ঘরে আবার ফিরে আসতেই আবার সেই শব্দ। তারপর আর যাওয়ার সাহস পাইনি।”
কাশিপুর রাজবাড়ি ও হাটতলা মোড়ের মাঝামাঝি অবস্থিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসের মধ্যেই হস্টেল। ২৪ জন ছাত্রী থাকে। জনবহুল এলাকার মধ্যেই ওই ছাত্রী নিবাস। তারপরেও যেভাবে ভূত আতঙ্ক চেপে বসেছে তাতে চরম অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। এমন অবস্থায় সোমবার থেকে স্কুলে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা শাখা কুসংস্কার বিরোধী প্রচার শুরু করেছে। নানা উদাহরণ দিয়ে তারা বোঝাচ্ছেন ভূত-পেত্নী, ডাইনি বলে কিছু নেই। এ সবই হ্যালুসিনেশন বা ভ্রম। এই ভ্রম কেন হয় বিজ্ঞান মঞ্চ প্রচারে সেটাও তুলে ধরছে। পরিস্থিতি জটিল হওয়ায় বিজ্ঞান মঞ্চের মহিলা শাখার সদস্যরাও ছাত্রীদের রীতিমতো কুসংস্কার বিরোধী পাঠ দিচ্ছেন। কিন্তু দিলে হবে কী, হোস্টেলের ছাত্রীদের কানে যে সেই মহিলার কান্নার আওয়াজই ধাক্কা খাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা শাখার সম্পাদক চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “অশরীরী বা ভূত বলে কিছু হয় না। সেটাই আমরা বৈজ্ঞানিক কারণ দেখিয়ে ছাত্রীদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। বুজরুকি দিয়ে নানাভাবে লোক ঠকানো যায় সেটা বুঝতে হবে। এখানেও এমন কোনও কিছু ঘটছে কিনা সেটা স্কুল কর্তৃপক্ষ দেখবে।” তাই ওই সব লোক ঠকানোর বিষয়গুলি সচেতনতা শিবিরে হাতে-কলমে দেখানো হয়। কিন্তু তাতে ছাত্রীদের ভীতি কাটলে তো!
[আরও পড়ুন: অপহরণের পর কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি, ১৪ দিন পর উদ্ধার বাগুইআটির দুই ছাত্রের দেহ]
স্কুল কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, এক শ্রেণির দালাল চক্র এই হোস্টেল খালি করার উদ্দেশ্যে ভয় দেখানোর খেলায় মেতেছে। কিন্তু প্রশ্ন তারা স্কুল ক্যাম্পাসে ছাত্রী নিবাসে ঢুকে এসব কাণ্ডকারখানা কীভাবে করছে? কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে , বিষয়গুলি তারা গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। কিন্তু প্রশ্ন এখন একটাই, রাতের অন্ধকারের সঙ্গে বাড়তে থাকা আতঙ্ক কাটবে কবে? কবে ফের স্বাভাবিক হবে কাশীপুর গার্লস স্কুলের হস্টেল?