শ্রীমন্ত চৌধুরি, গোয়া: এমনিতে গোয়ার ট্যাক্সি পরিষেবা মোটেই সন্তোষজনক নয়। ওলা-উবেরের অনুপস্থিতিতে ভরসা সেই ‘গোয়া মাইলস’। আমি যে ক্যাবটিতে ছিলাম সেটিও গোয়া মাইলসেই বুক করা। ডোনা পাওলা থেকে যাচ্ছিলাম বাগার দিকে। ৫৬ নং জাতীয় সড়কের উপরে যে পেল্লায় অটল সেতুটি তৈরি হয়েছে, সেটা দেখার ইচ্ছে ছিল। শেষ যেবার গোয়ায় এসেছিলাম, তখনও ব্রিজটি তৈরি হয়নি। মাণ্ডভীর বুকে সমান্তরাল জোড়া সেতু আগেই ছিল। তাঁর অনেকটা উপর দিয়ে তৈরি হয়েছে অটল সেতু। এই ব্রিজটি যে গোয়াবাসীর অনেক সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে, সেকথা বলাই বাহুল্য। উত্তর গোয়া আর দক্ষিণ গোয়ার কানেক্টিং লিংক হিসেবে কাজ করছে অটল সেতু।
[আরও পড়ুন: আমেঠিতে মনোনয়নের সময় রাহুলের মাথায় লেজার রশ্মি, রাজনাথকে চিঠি কংগ্রেসের]
আপাতত আমাদের ট্যাক্সিটিতে তিনজন প্রাণী। আমি, আমার সহকর্মী। আর আমাদের ক্যাব ড্রাইভার। আমাদের ট্যাক্সি চালক ছেলেটির মধ্যবয়স্ক, গোয়ানিজ। ওঁর কাছ থেকেই অটল সেতুর গল্প শুনছিলাম। ও বলছিল, “পারিকরজি বেঁচে থাকলে গোয়াটার আর একটু উন্নতি হত। কখনও দুর্নীতি সহ্য করতেন না। মোটরবাইকে ঘুরে বেড়াতেন। কোথাও কেউ টাকা মারেছে, দুর্নীতি করছে, জানতে পারলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যে ব্রিজটার উপর দিয়ে যাচ্ছি, সেই অটল সেতুও পারিকরজির স্বপ্ন ছিল। অসুস্থ অবস্থাতেই এটার উদ্বোধন করেছেন।”
কিন্তু পারিকর তো এখন অতীত। তাহলে, এবারে কী হবে? ভোটে অটল থাকবে বিজেপির গেরুয়া হাওয়া? লাখ টাকার প্রশ্ন। এ প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব না মিললেও তাঁর কথা শুনে যা বুঝলাম, তাতে গেরুয়া শিবির মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারবে না। ওঁর কথা অনুযায়ী, “এখানকার স্থানীয় বিজেপি নেতারা এখনও পারিকরের ছায়া থেকে বেরতে পারেননি। আর সেটাই কাল হতে পারে গেরুয়া শিবিরের।বিজেপি যেন এখনও পারিকরের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।” ছেলেটি বলছিল, যা পরিস্থিতি, তাতে গোয়ার দু’টি আসনের মধ্যে অন্তত একটি হাতছাড়া হচ্ছেই। দুটিই হাতছাড়া হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এসব কথার মাঝেই আমাদের গাড়ি, অটল সেতু পেরিয়ে গিয়েছে।বুঝলাম গোয়াবাসীর জন্য এই অটল সেতুটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আসলে, উত্তর আর দক্ষিণ গোয়ার মধ্যে যাতায়াতটা অনেকটাই সহজ করেছে মাণ্ডভীর উপর গড়ে ওঠা পেল্লাই ব্রিজটি। সেতুটির যখন উদ্বোধন হয়, তখন পারিকর বেশ অসুস্থ ছিলেন। বিরোধীরা লাগাতার সরকার ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়ে যাচ্ছিল। গোয়ার বাসিন্দাদের একাংশও মুখ্যমন্ত্রীর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার মধ্যেই, ২৭ জানুয়ারি স্বমহিমায় প্রকাশ্যে এসেছিলেন গোয়াবাসীর ‘প্রাণপুরুষ’। সেদিন, সেতুটির উদ্বোধন করে পারিকর বিরোধীদের প্রশ্ন করেছিলেন, হাউ’জ দ্য জোশ। আসলে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, শরীর ভগ্ন হলেও, গোয়াবাসীর জন্য তাঁর জোশের কমতি হবে না।
[আরও পড়ুন: ‘২০০৪-এর ঘটনা ভুলে নিজেদের অজেয় ভাববেন না’, বিজেপিকে কটাক্ষ সোনিয়ার]
এ হেন এক নেতার মৃত্যুর পর গোয়াবাসীর জোশ জানার জন্য, এখানে এসে ইস্তক বেশ কয়েকজনের সঙ্গেই কথা হয়েছে। বেশিরভাগের মুখেই যেন উলটো সুর। এমনিতে, গোয়ার পরিবেশ দেখে ভোটের উত্তাপ আন্দাজ করার জো নেই। রাস্তায় ব্যানার-ফেস্টুন কোনও দলেরই নেই। প্রার্থীর নাম জানতে হলেও, আপনাকে ইন্টারনেটে সার্চ করতে হবে। কোনও দেওয়াল বা ব্যানার দেখে জেনে নেবেন সে উপায়টিও নেই। এমনকী প্রধানমন্ত্রীর সভা ঘিরেও সেই উচ্ছ্বাস নেই। বুধবারই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্টেডিয়ামে মোদির সভা ছিল। সেই সভায় তিনি কংগ্রেসকে অনেক গালমন্দ করেছেন। সেকথায় পরে আসা যাবে, এখন মোদ্দা কথা হল, সৈকত শহরে ভোটের মেজাজ আন্দাজ করতে হলে মানুষের সাথে কথা বলা ছাড়া উপায় নেই। এখানে আসার আগে ধারণা ছিল, পারিকর আবেগে ভর করে অতি সহজেই গোয়ার দুটি আসন পকেটে পুরবে বিজেপি। কিন্তু, স্থানীয়দের সাথে কথা বলে সেই ধারণা কিছুটা বদলাল।
যাক গে, এসব কথার মধ্যে আবার কখন গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি টেরই পাইনি। ভোটের চিন্তায় খানিক বিরাম দিয়ে, যে কাজে এসেছিলাম সেই কাজটি আগে শেষ করতে মনোনিবেশ করলাম। রাতে বাগা থেকে ডোনা পাওলা ফেরার পর আর একটা জিনিসে একটু খটকা লাগল। যে গোয়া রাতভর জেগে থাকতে অভ্যস্ত, সেখানে রাত ১১টার সময় একটা জলের বোতল পর্যন্ত মিলছে না। দোকানপাট সব বন্ধ। তখনই আঁচ করলাম। প্রকাশ্যে নির্বিকার হলেও, তলায় তলায় নির্বাচনী উত্তাপে ফুটছে সৈকতনগরী। ২৩ তারিখ এখানে নির্বাচনী যুদ্ধ৷
[আরও পড়ুন: নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে উত্তাপেও শান্তির ভোট অসমে]
আগেই বলেছিলাম, বুধবারই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সভা ছিল গোয়ায়। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্টেডিয়ামে মোদির সভায় ভিড়টা প্রত্যাশিতভাবেই ছিল চোখে পড়ার মতো। শুনলাম তিনি নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ক্ষমতায় এলে গোয়ার মাইনিং শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করবেন। গোয়ায় নেমেই বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে ট্যাক্সিচালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানাচ্ছিলেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরে মাইনিং একেবারে বন্ধ। যাতে প্রচুর মানুষকে কাজ হারাতে হয়েছে। পারিকরহীন বিজেপি এবার অস্ত্র করছে সেই মাইনিং শিল্পকেই। আরেকটি অস্ত্র, পারিকরের তৈরি করা অটল সেতু। এই দুই অস্ত্রকে হাতিয়ার করে আর পারিকরের আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দুর্গ অটল রাখার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গেরুয়া শিবির। সেই প্রচেষ্টা সফল হবে কিনা, সেটা জানতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে ২৩ মে পর্যন্ত।
The post অতিরিক্ত পারিকর-নির্ভরতাই মাথাব্যথার কারণ! গোয়া নিয়ে চিন্তায় বিজেপি appeared first on Sangbad Pratidin.