বিশ্বদীপ দে: এ পৃথিবীর মধ্যে আছে আর একটা পৃথিবী। শঙ্খ ঘোষের অতি বিখ্যাত পঙক্তিকে একটু বদলে নিলেই তা দিব্যি ‘হলো আর্থে’র ক্যাচলাইন হয়ে যেতে পারে। ‘হলো আর্থ’। পৃথিবীর নিচে অবস্থিত আরও একটা জগৎ। এই দুই দুনিয়ার ভিতরই ঘোরাফেরা করে কং-গডজিলা সিরিজের গল্প। আগের ছবিতে যারা ছিল প্রবল প্রতিপক্ষ, তারাই এবার জোট বেঁধেছে। কেন? কাদের সঙ্গে তাদের লড়াই? ট্রেলার দেখে থাকলেই বুঝে যাবেন ‘দুশমন বহুত দুর্ধর্ষ’।
স্কার কিং নামের এক অতিকায় বদমাশ আধা শিম্পাঞ্জি আধা ওরাং ওটাং এখন হলো আর্থ দখল করে নিতে চায়। তার এক সাংঘাতিক পোষ্যও রয়েছে (সে আবার গডজিলারই জাতভাই, এর বেশি বললে স্পয়লার হয়ে যাবে)। এই দুই দলের দ্বৈরথই ছবির নিউক্লিয়াস। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের দুর্দান্ত বিনোদন। কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় বোঝাই যায় না। ‘লেজেন্ডারি পিকচার্স’-এর মনস্টার ইউনিভার্সের পঞ্চম ছবি ‘গডজিলা X কং: দ্য নিউ এম্পায়ার’।
আগের চারটি ছবি ‘গডজিলা’, ‘কং: স্কাল আইল্যান্ড’, ‘গডজিলা: কিং অফ দ্য মনস্টার্স’ ও ‘গডজিলা ভার্সেস কং’ দেখা থাকলে এই ছবিকে প্রথম থেকে বুঝতে সুবিধা হবে। তবে দেখা না থাকলেও খুব বেশি সময় লাগে না ছবির সঙ্গে মিশে যেতে। ছবির শুরুতেই এন্ট্রি কংয়ের। গডজিলার দেখা মেলে সামান্য পরে। কং বেচারি দাঁতের ব্যথায় কাবু। তার দাঁত তোলার দৃশ্যটা অনবদ্য। এদিকে গডজিলা কী এক ইশারায় জেগে উঠেছে ঘুম ভেঙে! ধীরে ধীরে গল্প এগোয়। আর তৈরি হতে থাকে এক মহা সংঘাতের আবহ।
[আরও পড়ুন: ‘আমি জয়ার মতো নই’, নিজেকে ‘ভালো মানুষ’ বলে মিসেস বচ্চনকে খোঁটা মৌসুমীর]
আগেই বলেছি ছবির প্রধান ভিলেন স্কার কিং। আকারে সে কিন্তু কংয়ের মতো বিপুলদেহী নয়। কিন্তু ক্রুরতায় চমকে দেয়। যেহেতু মানুষের কাছাকাছি প্রজাতির, তাই তার মধ্যে একনায়ক হয়ে ওঠার বদগুণ দিব্যি এঁটে বসেছে। অসংখ্য অতিকায় বানর জাতীয় প্রাণী, ওরাং ওটাংদের ভৃত্য বানিয়ে সে জাঁকিয়ে বসেছে। তার অতিকায় পোষ্যের কথা তো আগেই বলেছি। এহেন পরিস্থিতিতে এমন জাঁদরেল শত্রুদের সঙ্গে কং একা কেন পারবে? প্রথম রাউন্ডে সে তাই পরাজিত। তাকে সাহায্য করতে দরকার পড়ে গডজিলার। কিন্তু আগের ছবিতে সামান্য ‘দোস্তি’ হলেও তাদের শত্রুতা তো কমদিনের নয়। তাই শুরুতে খানিক সংঘাত তাদের মধ্যেও হয়। এই ছবির মজা হল, শেষে কী হবে সবার জানা। তবু কখনও বিরক্ত লাগে না। এক অতি-পৃথিবীর ভিতরে ভেসে থাকতে বেশ লাগে।
এই ছবির মানুষ অভিনেতারাও বেশ ভালো। রেবেকা হল, ড্যান স্টিভেন্স, ব্রায়ান টিরি হেনরিরা প্রত্যেকেই সপ্রতিভ। এবং অনাথ বালিকা জিয়ার চরিত্রে কেলি হটল। বিশেষ করে কেলি ও রেবেকার মধ্যে স্নেহের যে রসায়ন, তা সুন্দর। কিন্তু মানতেই হবে এখানে মানুষদের টেক্কা দিয়েছে না-মানুষরা। কং ও পুঁচকে ওরাং ওটাং সুকোর মধ্যে ধীরে ধীরে যেভাবে সখ্য গড়ে ওঠে, সেই বাৎসল্য যেন আরও বেশি সুন্দর। সুকোর সাহস ও ভালোবাসা মুগ্ধ করে। কং-গডজিলার মতো মহাতারকাদের পাশাপাশি সিনেমা হলের সিটি, হাততালির খানিকটা তার জন্যও বরাদ্দ রয়েছে।
তবু... অতিকায় এই সব টাইটানদের দাপাদাপি, স্পেশাল এফেক্টসের জাদু সত্ত্বেও কয়েকটা কথা থেকে যায়। এই ধরনের ছবিতে যে ‘টুইস্ট’ থাকে তেমন কিছু এখানে নেই। গল্প এগোয় নিতান্তই একরৈখিক ভাবে। হল থেকে বেরিয়ে তাই মনে হয়, এমন দুর্দান্ত প্রযুক্তি যখন হাতে, গল্পটায় আরও খানিক যত্নবান হওয়া যেত না কি? ছবির চিত্রনাট্যে একটা ব্যালান্স রাখার চেষ্টা আছে। রুদ্ধশ্বাস অভিযানের মধ্যে তাই কমিক রিলিফও গুঁজে দেওয়া হয়েছে। সেটা ভালোই। কিন্তু সাসপেন্স ব্যাপারটা তেমন জমেনি। এসব কথা আপনার মনে আসতে পারে ছবি দেখে বেরিয়ে। তবে অন্ধকার হলে পর্দায় ত্রিমাত্রিক কারসাজি দেখার সময় অত কিছু মাথায় আসে না।
কিং কং বনাম গডজিলা বছর তিনেক আগে কোভিডকালেও দারুণ ব্যবসা করেছিল এদেশে। এই ছবিও যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে মুহুর্মুহু হাততালি আর উল্লাসধ্বনি সেটাই প্রমাণ করে। কিং কং ও গডজিলা দশকের পর দশক ধরে সারা পৃথিবীর ফ্যান্টাসিপ্রেমীদের স্বপ্নে বাসা বেঁধে রয়েছে। হয়ে উঠেছে মহাতারকা। এহেন সুপারস্টারদের একসঙ্গে দেখতে পাওয়া, সেই সঙ্গে আরও এতগুলো মনস্টার (সবাই প্রাণী নয়, মানুষখেকো গাছও রয়েছে)— বিনোদনের এমন মশলায় ভিএফএক্স ও কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সঙ্গতে যে সুস্বাদু পদ তৈরি হয় তা সময়ে সময়ে হাতে ধরা পপকর্নকেও মাত করে দেবে এতে আর আশ্চর্য কী?