১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাষার ভিত্তিতে যখন প্রদেশ গঠন হয়, তখন সে ছিল এক বিষম সমস্যা। ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য ভাগ ঠিক না ভুল, সে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। বিতর্কের রেশ এখনও থেকে গিয়েছে। বাংলাকে প্রকারে-প্রকারান্তরে বারবার ভাঙার চেষ্টা চলছে। তা আগুন নিয়ে খেলার সমতুল্য। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
পৃথিবীর ইতিহাসে দু’টি শক্তি ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো একবার এদিক তো আর-একবার ওদিক করে। প্রথমটি, ঐক্য ও সম্প্রসারণের শক্তি। দ্বিতীয়টি, বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতার শক্তি। জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বিসমার্কের ইতালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আবার, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছে নানা ছোট ছোট সার্বভৌম রাষ্ট্রে- বলকানাইজেশন। ভারতে সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে বিশাল সাম্রাজ্য গঠিত হয়েছিল। আবার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ভারতের ইতিহাসে নানা জনপথকে আলাদা করেছে স্বাধীনতার আগে, স্বাধীনতার পরেও।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাষার ভিত্তিতে যখন প্রদেশ গঠন হয়, তখন সে ছিল এক বিষম সমস্যা। ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য ভাগ ঠিক না ভুল, সে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। বিতর্কের রেশ এখনও থেকে গিয়েছে। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড এসব ভিন্ন রাজ্য গঠিত হয়েছে। বিজেপি মতাদর্শগতভাবেও মনে করেছে, বড় রাজ্যকে ছোট রাজ্যে বিভাজন করা হলে হয়তো উন্নয়নের রথ আরও দ্রুতগামী হবে। মানুষের স্বায়ত্তশাসনের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক পরিচিতি আরও উন্মুক্ত হবে।
[আরও পড়ুন: ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’, ঔদ্ধত্যই ছিল সিপিএমের ‘ঐতিহাসিক ভুল’]
অধুনা উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বার্লা বারবার দাবি করছেন, উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু এলাকা নিয়ে আলাদা রাজ্য অথবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করতে হবে। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছেন, এটি ওঁর ব্যক্তিগত অভিমত, দলের রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধি হয়ে, ফ্যাসাদে পড়েছেন। রাজ্য বিজেপির নেতৃত্ব এ-কথা না বললেও দেখা যাচ্ছে, বিজেপির নদিয়ার বিধায়ক অসীম সরকার ঘোষণা করছেন, আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল প্রয়োজন। এমনকী, তিনি এটাও বলেছেন যে, পৃথক মতুয়া জনপদ গঠন করা দরকার। বিজেপি নেতা সৌমিত্র খাঁ বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে বলছেন, পশ্চিমাঞ্চলেও স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন। উন্নয়নের রথ চালাতে গেলে জঙ্গলমহল হোক একটি পৃথক রাজ্য অথবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। সোজা কথায়- মমতা সরকারের নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত করে যদি কেন্দ্রের সাহায্যের ভরসায় পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করা যায়, তবে তাতেই সেখানকার মানুষের মুক্তি, সেখানে হবে অপার উন্নতি।
বিজেপির সর্বভারতীয় শীর্ষ নেতৃত্ব এ-ব্যাপারে মুখ খোলেনি। কিন্তু দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্ত যখন সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যর বাড়িতে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ করতে যান, তখন জানা যায়, সেখানেও উত্তরবঙ্গকে পৃথক কতগুলি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভাজন করার আলোচনা হয়েছে। অশোক ভট্টাচার্য সে-কথা অস্বীকার করেছেন। দার্জিলিংয়ের সাংসদও এ ব্যাপারে আলাদা করে কথা বলেননি। যদিও পর্যবেক্ষকদের মত, পৃথক জাতিসত্তার ভিত্তিতে দার্জিলিংকেও পৃথক রাজ্য করার দাবিতে তিনি যথেষ্ট সক্রিয়।
দার্জিলিংয়ে যশবন্ত সিং সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। তখন থেকেই বিজেপি পৃথক ‘গোর্খাল্যান্ড’ রাজ্যের কথা মেনে নিয়ে বিমল গুরুংকে সঙ্গে পেতে চেয়েছিল। মনে আছে, বিজেপির ইস্তাহার গঠনের সময় বিমল গুরুংয়ের চাপে গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবির কথা একটা আলাদা কাগজে লিখে সেটা ইস্তাহারে সংযোজনী প্রস্তাব হিসাবে রাখা হয়।
মোদি-শাহ নিশ্চয়ই জানেন, এই দাবি রাজ্যস্তরে তোলা মানে ‘শাঁখের করাত’। প্রথমত, সংবিধান অনুসারে বিধানসভার দুই-তৃতীয়াংশ অনুমোদন ছাড়া কেন্দ্র একতরফা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা পৃথক রাজ্য করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরে যেরকম লাদাখকে রাজ্যসভার বিল এনে পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে, সেটা বঙ্গে সম্ভব নয়। তা করতে গেলে এখানে ৩৫৬ ধারা জারি করে আগে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে। কেননা, নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কথা না বলে এবং বিধানসভায় দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন ছাড়া এ কাজ করা যায় না। তাহলে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব কি সে-কাজটি করতে প্রস্তুত?
রাজ্য-বিজেপি নেতাদের একাংশ এটিকে রাজনৈতিক ইস্যু করলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত। তারা জানে, বিষয়টা এত সোজা নয়। তাছাড়া, উত্তরবঙ্গের নেতারা এই ব্যাপারে সরব হলেও সমতলে এর একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। ‘গোর্খাল্যান্ড’ বিষয়টাকে সমর্থন করতে গেলে যে কলকাতা তথা দক্ষিণবঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, সেটাও বিজেপির জানা। সুতরাং, এই পরিস্থিতিতে মোদি এবং অমিত শাহ জেলাস্তরের বিজেপি নেতাদেরকে দিয়ে এসব কথা বলিয়ে এলাকার মানুষের সমর্থন আদায় করার রণকৌশল নিতে পারেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কখনওই এটিকে বাস্তবায়িত করার কথা ভাবতে পারে না- আমার তাই প্রত্যয়।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তামিলনাড়ু থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা ভুলতে পারিনি। ১৯৫৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ যখন আলাদা হয় তখন তামিলনাড়ুর নেতা রাজাগোপালাচারী খুবই ক্ষুব্ধ হন। তিনি প্রথম থেকেই এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিলেন। তেলেঙ্গানা আন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে, পট্টি শ্রীরামালু অনশনে বসেন, তখন নেহরু বিচলিত হন। নেহরু তেলেঙ্গানাকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু সর্দার প্যাটেল এবং রাজাজির আপত্তিতে তিনি পিছিয়ে আসেন। পট্টি শ্রীরামালু অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ আলাদা হয়, যদিও তেলেঙ্গানা থেকে যায় অন্ধ্রপ্রদেশের ভিতর। ১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠন আইন তৈরি হয়। সেই আইনে আরও বেশি করে কেন্দ্রের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়। বহু বছর পর মনমোহন সিংহের সময় অবশ্য সোনিয়া গান্ধী পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যকে সমর্থন করেন। পৃথক তেলেঙ্গানা গঠিতও হয়। তাতে অবশ্য কংগ্রেসের লাভের থেকে রাজনৈতিক লোকসান বেশি হয়েছে।
এখন মনে হয়, এই পৃথক রাজ্য গঠনের যে-রাজনীতি সেটা যতটা না উন্নয়নের কথা ভেবে, যতটা না এলাকার আত্মপরিচিতির জন্য, তার থেকে বেশি ক্ষমতার রাজনীতি। অর্থাৎ, যদি পশ্চিমবঙ্গকে বেশ কয়েকটা ভাগে ভাগ করে দেওয়া যায়, তাতে মমতার সরকারকে দুর্বল করে দেওয়া সহজ হবে। ২০২১-এ উত্তরবঙ্গে বিজেপি যে ২৬টা আসন পেয়েছে, সেগুলোকে ধরে রাখার জন্য এই প্রচারটা জরুরি।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাবি উঠেছে। সেই নথি গোপন নয়। গুগ্লে সার্চ করে যে কেউ সেটা পেতে পারেন। সেখানে দেখছিলাম- উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং, কালিম্পং, উত্তর এবং দক্ষিণ দিনাজপুর নিয়ে পৃথক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব শুধু নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের দাবি রয়েছে। কাজেই, একবার পশ্চিমবঙ্গের জন্যে যদি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ছাড়পত্র দেয়, তাহলে কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ২০২৪ সালের আগে প্যান্ডোরার বাক্স খুলবেন। তখন অসমে আবার বোড়োল্যান্ডের দাবি উঠবে। এছাড়া কাছাড়ে যে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি উঠবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? ছোট্ট রাজ্য মিজোরাম, সেখানেও চাকমাদের জন্য চাকমাল্যান্ডের আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাবি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে জমা পড়েছে। উত্তরপ্রদেশের বৃন্দাবন ও মথুরাকে ব্রজভূমি ঘোষণা করার দাবি আছে। তখন মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড কিংবা বাঘেলখণ্ড, উত্তরপ্রদেশের আওয়াধ বা অসমের ভিল- চারদিক থেকে যদি বিচ্ছিন্নতাবাদের এই টুকরো হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে, তখন নরেন্দ্র মোদির ‘অখণ্ড ভারত’-এর প্রচারই তো ধাক্কা খাবে! সুতরাং আশা করা যায়, আগুন নিয়ে এই খেলাটা মোদি-শাহ জুটি শেষ পর্যন্ত মেনে নেবেন না।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতা আসছেন। সেখানে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও থাকবেন। উত্তরবঙ্গের একটি এলাকার সঙ্গে বিহারের পুর্ণিয়া যুক্ত করে দিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে। ২০২৪-এর আগে যে নীতীশ কুমার বিরোধী দলনেতা হিসাবে মাথা চাড়া দিতে চাইছেন, সেখানে এই ধরনের রাজনীতি তো বিরোধী নেতাদের ঐক্যকেই আরও ত্বরান্বিত করবে। অতএব, পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য-বিজেপির জেলার কিছু নেতা এই জাতীয় প্রেক্ষাপট বোধহয় বুঝেও বুঝতে পারছেন না।একটাই কথা বারবার মনে হচ্ছে, আমাদের বাংলা দু’-দু’বার বিভাজিত হয়েছে। আর যাই হোক, আগুন নিয়ে খেলা কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য অশুভ। তাতে কল্যাণ নেই।