সৌরভ মাজি, বর্ধমান: বাংলার জনপ্রিয় প্রবাদ – যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে! কম বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। সেই বয়সে হেসেখেলে কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু বিধির বিধান। সংসারের জোয়াল কাঁধে চেপে যায়। হাতা-খুন্তি ধরা হাতে তুলে নিতে হয় খড়, বাঁশ, কাদামাটি, রঙ, তুলি। সাড়ে তিন দশক ধরে সমানভাবে দুই দিক সামলে চলেছেন পূর্ব বর্ধমানের (East Burdwan) জামালপুরের ছোতোর পাড়ার মাধবী সাঁই। ফি বছর ২০ থেকে ২২টি দেবী মূর্তি তৈরি করেন তিনি। একসময় সংসার টানতে যে কাজ শুরু করেছিলেন, এখন সেটাই পেশা হয়েছে গিয়েছে।
শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ জমছে মাঝেমাঝে। আবার কখনও মুষলধারায় বৃষ্টিও হচ্ছে। দামোদরের বক্ষে কাশবনে ঢেউ উঠছে। সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নেই মাধবীর। নিজের মাঠকোটা বাড়ির একচিলতে অংশে কুমোরটুলি গড়ে ফেলেছেন। সেখানে নিমগ্ন প্রতিমা শিল্পী মাধবী। বাঁশের কাঠামোয় খড় আর দড়ি দিয়ে কাঠামো প্রস্তুত করে মাটির প্রলেপ দিতে ব্যস্ত। আগে মাটির প্রলেপ দেওয়া প্রতিমায় চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। তুলি হাতে রঙের পোঁচ দিচ্ছেন মাধবী।
[আরও পডুন: দত্তপুকুরে ফের বিস্ফোরণ, বল ভেবে খেলতে গিয়ে জখম ৫ কিশোর]
তাঁর বাবা ছিলেন প্রতিমা শিল্পী। ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে কাদামাটি, রং, তুলি নিয়ে পাশে থাকতেন মাধবী। যত্ন করে পর্যবেক্ষণ করতেন বাবা কীভাবে মৃন্ময়ীকে চিন্ময়ী রূপ দিতেন। বাবার কাছে শিখেছিলেন প্রতিমা তৈরির খুঁটিনাটি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হয়ে কোনওদিন কল্পনা করেননি বাবার পেশাই একদিন নিজের পেশা হয়ে যাবে। মাধবী বলেন, “২৭ বছর আগে অকস্মাৎ মৃত্যু হয় শিবপদর। সংসারে অনটন দেখা দেয়। আমার কোনও দাদা, ভাইবোন নেই। সংসার চালাতে বাবার পেশাকেই। তার আগে বাবাকে প্রতিমা তৈরিতে সাহায্য করতাম। বাবার মৃত্যুর পর এককভাবে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু করি। এখনও করে চলেছি।”
মাধবীর সঙ্গে বিয়ে হয় হুগলির ভাণ্ডারহাটির বিশ্বনাথ সাঁইয়ের। যদিও স্বামীকে নিয়ে বাবার ভিটেতেই বসবাস করেন। মাধবীর দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট মেয়ে তাঁদের কাছেই থাকে। বিশ্বনাথবাবু আগে অন্য পেশায় ছিলেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেইভাবে আর কাজ করতে পারেন না। তাই মাধবীই প্রতিমা গড়ার কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় ২০ থেকে ২২টি প্রতিমা গড়েন। এবারেও গড়ছেন। প্রতিমা গড়ার কাজে তাঁকে স্বামী ও মেয়ে সহায়তা করেন। বিশ্বনাথবাবু বলেন, “আমি প্রতিমা তৈরির উপকরণ এনে দিই। টুকটাক সাহায্য করি। প্রতিমা গড়ার পুরো কাজ ওই করে।”
[আরও পডুন: অভিষেকদের দিল্লি অভিযানকে ‘তামাশা’ বললেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, পালটা দিল তৃণমূল]
অন্যান্য পুজোর সময়েও মূর্তি গড়ার কাজ করেন মাধবী। তবে সারাবছর ভালোভাবে সংসার চালাতে দুর্গোৎসবই সব থেকে ভরসার জায়গা। তাই মাধবীই যেন দশভুজা হয়ে দশভুজার মূর্তি গড়তে নেমে পড়েন। মা দুগ্গাই তো সম্বৎসর বেঁচে থাকার রসদের জোগান দিয়ে যান। মাধবী অপেক্ষায় থাকেন আবার কবে কৈলাশ থেকে মায়ের মর্তে আসার সময় হবে। জয় দুগ্গা বলে নেমে পড়বেন মায়ের অবয়ব গড়ার কাজে।
দেখুন ভিডিও: