অরিঞ্জয় বোস: ‘বসকিয়ানা’। নার্গিস রোডের বিখ্যাত বাড়ি। তবে বাড়ির চেয়েও বিখ্যাত তার বাসিন্দা। গুলজার।
অভিজাত পশ্চিম বান্দ্রার এই বাড়িতে যাওয়ার মুখ্য কারণটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর ‘বাহ্ শচীন’- শচীন তেন্ডুলকরের ৫০ পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে শচীনকে নিয়ে কলম ধরেছিলেন গুলজার সাহেব। সেই ক্রোড়পত্রটি ওঁর হাতে তুলে দিতেই ওঁর বাসভবনে বোরিয়া মজুমদারের সঙ্গে গিয়েছিলাম।
গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। বাড়িতে তখন মেরামতির কাজ চলছে। গাড়ি থেকে নেমেছি। ব্যাগ থেকে বই বের করছে বোরিয়াদা। হঠাৎ দেখি, তিনি কখন যেন সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। ভাবা যায়! প্রায় ছুটে গিয়ে দু’জনে তাঁকে প্রণাম করলাম। এরপর আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর বিখ্যাত বসার ঘরে। যে-ঘরে শোভা পাচ্ছে গালিবের একটি অদ্ভুত সুন্দর মূর্তি। আর, গালিবের পাশে শ্বেতপাথরের গণেশ। পাশে রাইটিং টেবিল। এ-ই হলেন গুলজার। যে ঘরে গালিব এবং গণেশ– সেখানে গুলজার লেখেন। সৃজন ঘটে এমন কিছু মণিমুক্তপ্রতিম শব্দদ্য়ুতির, যা তিনিই পারেন রচনা করতে।
ঘরে বসার কিছুক্ষণের মধ্যে এল তুলসীর চা আর লখনউয়ের বিখ্যাত বেকারির বিস্কুট। সোফায় বসে শুরুতেই বললেন, ‘আমি রবিবার দিন কারও সঙ্গে দেখা করি না, এমনকী আয়নাতেও নিজের মুখ দেখি না। কিন্তু তোমরা কলকাতা থেকে এসেছ, তাই তোমাদের সঙ্গে দেখা না করে উপায় নেই।’
সুযোগ পেয়ে আমি বললাম যে, ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল উনি যখন কলকাতায় এসেছিলেন ওঁরই লেখা বই ‘পান্তাভাতে’ উদ্বোধন করতে, তখন। স্বভাবতই সে কথা ওঁর মনে থাকার কথা নয়। তবে আমার স্মৃতিতে তা উজ্জ্বল হয়ে আছে, চিরভাস্বর হয়ে থাকবেও। কথায়-কথায় আড্ডার মেয়াদ বাড়তে থাকল। বোরিয়াদার প্রথম থেকেই কৌতূহল ছিল বাড়ির নাম ‘বসকিয়ানা’ কেন? শেষ পর্যন্ত কৌতূহল সামলাতে না পেরে গুলজার সাহেবকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল বোরিয়াদা। উত্তরে গুলজার সাহেব বললেন যেটা- তাঁর মেয়ের নাম ‘বসকি’। বসকির আশিয়ানা অর্থে ‘বসকিয়ানা’। সে নামেই বাড়ির নাম।
[আরও পড়ুন: আচমকাই ইস্তফা এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ারের, ভবিষ্যৎ নেতা কে?]
আমার খুব ইচ্ছা ছিল, কথা বলার সুযোগ পেলে সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কে জানতে চাইব ওঁর থেকে। বইয়ে পড়েছি অল্পবিস্তর। কিন্তু ওঁর মুখ থেকে তা শোনা অন্য অভিজ্ঞতা। গলার চাদরটি উড়িয়ে শাহি মেজাজে গুলজার সাহেব বলতে শুরু করলেন তাঁর ‘মানিকদা’কে নিয়ে। প্রথম নাকি ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায়ই বলেছিলেন গুলজারকে যে, সত্যজিৎ রায় ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। ‘সান অ্যান্ড স্যান্ড’ হোটেলে। তা, গিয়ে দেখলেন সত্যজিৎ রায় হোটেলের বাগানে বসে আছেন। কাছে যেতে গম্ভীর কণ্ঠে, জাঁদরেল অ্যাকসেন্টে বললেন, ‘গুলজার?’ তাঁর মনে হয়েছিল যেন কোনও সাহেব তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। “আমি ‘হ্য়াঁ’ বলতেই মানিকদা আমাকে বললেন, তিনি নাকি আমাকে কমপ্লিমেন্ট দিতে চান। অনেকেই নাকি আমার ব্যাপারে মানিকদাকে বলেছেন।” অবাক হয়ে গুলজার সাহেব আমাদের বললেন, ‘একজন বাঙালি যে এত ভাল ইংরেজি বলতে পারেন, না শুনলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। মনে হচ্ছিল ব্রিটিশ সাহেব। কিন্তু যখন বাংলা বলেন, তখন টোটাল বাঙালি।’
একটু ভয়ে-ভয়েই নাকি সেদিন সত্যজিৎ রায়কে (Satyajit Ray) ‘মানিকদা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন গুলজার। ভয় এই কারণে যে, যদি উনি রাগ করেন। কিন্তু রাগ করা তো দূরস্ত, বরং সত্যজিৎ রায় সেদিন কথার মাধুর্যে ভারি আপন করে নিয়েছিলেন গুলজার সাহেবকে। সেই সময় সত্যজিৎ রায় নাকি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ হিন্দিতে করতে চেয়েছিলেন। গুলজার সাহেবের সঙ্গে সেই হিন্দি ভার্সন ‘গুগাবাবা’ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
“মানিকদার সবচেয়ে বেশি চিন্তা ছিল হিন্দি ছবিতে বাঙালি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর মাধুর্য যেন নষ্ট না হয়ে যায়!” আমাদের বলছিলেন গুলজার। ভুবনজোড়া খ্যাতি যে চিত্র পরিচালকের, তাঁর মাতৃভাষার প্রতি অমোঘ টান আজও আকৃষ্ট করে গুলজারকে। কোনও আপস করতে চাননি নিজের মাতৃভাষার সঙ্গে। চশমা ঠিক করতে করতে গুলজার সাহেব বলছিলেন, “মানিকদা সেদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখেছ?’ আমি বললাম, হ্য়াঁ, দেখেছি ছবিটা।”
বোরিয়াদার দিকে তাকিয়ে এরপর গুলজার বললেন, ক্রিকেটে যেমন ‘গুগলি’ হয়, ঠিক তেমন করে নাকি গুগলি দিয়ে মানিকবাবু গুলজারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘সাদাসিধা মাটির মানুষ’-এর হিন্দি অনুবাদ কী হবে? গুলজার উত্তরে বলেছিলেন, ‘সাদাসিধা’কে পালটানোর দরকার নেই, ওটা একভাবেই রাখা যেতে পারে। এই উত্তর শুনে সত্যজিৎ রায় চিরাচরিত গম্ভীর গলায় বলে উঠেছিলেন, ‘গুড, গুড।’
তারপর কী হল? আমরা কৌতূহলী। উনি বললেন, “বম্বেতে দেখা হওয়ার পর উনি আমাকে কলকাতায় যেতে বলেন, স্ক্রিপ্ট নিয়ে ডিটেলসে কথা বলবেন বলে। তারপর আমি যখন কলকাতা গেলাম ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হল। ওঁর বাড়িতে। অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললেন, ‘গুগাবাবা’র স্ক্রিপ্টটা নিয়ে আসতে। আনার পর নিজে হাতে আমাকে গানগুলো লিখে দিলেন মানিকদা। একজন মানুষ নিজের প্রোজেক্ট সম্পর্কে কতটা নিখুঁত, ওঁকে দেখে শিখলাম। মানিকদার হাতে লেখা সেই গানগুলো এখনও আমার কাছে আছে।”
চা খেতে-খেতে তৃপ্তির স্বরে বলছিলেন গুলজার সাহেব। কিন্তু ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ হল না হিন্দিতে। আক্ষেপের সুরে গুলজার বললেন, ‘সারা ভারত এরকম অসামান্য একটি ছবি দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হল।’ প্রথম ছবিতে কাজ না করতে পারলেও মানিকবাবুর সঙ্গে গুলজারের সম্পর্ক স্থায়ী হয়, রয়ে যায়। গুলজার সাহেব বলছিলেন, ওঁর নাকি ‘নিউ থিয়েটার্স’-এ প্রায় যাতায়াত ছিল। তরুণ মজুমদারের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে একবার ‘নিউ থিয়েটার্স’-এ গিয়ে গুলজার সাহেব দেখেন- সত্যজিৎ রায়, শশী কাপুর-সহ আরও কয়েকজন দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। দূর থেকে দাঁড়িয়ে গুলজার শুনছিলেন তাঁদের কথা। কী কথা? আমরা কৌতূহলী আবারও।
উনি বললেন, “দূর থেকে যেটুকু শোনা যাচ্ছিল, ওঁরা বলছিলেন, ‘if we do not have money to spend, we have to spend our brain.’ এই কথাটাই নাকি গুলজারের মনকে নাড়া দিয়েছিল। নিজেও তাঁর জীবনের চলার পথে এই উক্তি প্রয়োগ করতে চেয়েছেন বারবার, বরাবর। ‘এরপর আবার কাজ করার সুযোগ আসে মানিকদার সঙ্গে।’ উৎসাহের সঙ্গে ফের চাদর জড়িয়ে বলতে শুরু করেন গুলজার।
করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে একবার ‘প্রফেসর শঙ্কু’ নিয়ে দিল্লি দূরদর্শনে সিরিয়াল করতে চেয়েছিল। গুলজার সাহেব সেই স্ক্রিপ্ট লেখার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। স্ক্রিপ্ট ফাইনাল দেখে সিলমোহর দেবেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। কিছুদিন পর গুলজার সাহেব বম্বেতে খবর পান, সেই সিরিয়ালও নাকি হবে না। মানিকবাবু নিজেই নাকি সেই কাজ করবেন। গুলজার সাহেব বললেন, ‘আমি ভাবলাম আমার স্ক্রিপ্ট হয়তো মানিকদার পছন্দ হয়নি। কিন্তু লোকেরা আমাকে বোঝাল, নিশ্চয়ই এই স্ক্রিপ্ট থেকে অসাধারণ কিছু একটা হতে পারে, তাই হয়তো মানিকদা এই স্ক্রিপ্ট রিজার্ভ করে রেখে দিয়েছেন।’ যতই লোকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করুক না কেন, মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাঁর, কারণ এবারও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করা হল না যে!
[আরও পড়ুন: বিজেপির জগদ্দল পাথর নড়াতে সার্বিক বিরোধী ঐক্য ছাড়া গতি নেই]
‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সিনেমা করবেন শুনে ছুটে গিয়েছিলেন গুলজার। গিয়ে শুনলেন, সত্যজিৎ রায় ফ্লাইট ধরতে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছেন। শুনে আর-একটা ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে ছোটেন গুলজার। টিকিট কেটে এয়ারপোর্টের ভিতরে দেখা করতে গিয়েছিলেন মানিকবাবুর সঙ্গে। দেখা করে বলেছিলেন– তিনি কাজ করতে চান এই ছবিটির। উত্তরে নাকি সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, এই কাজটি অন্য একজনকে দিয়ে দিয়েছেন। ভারাক্রান্ত মনে ফিরে আসতে হয়েছিল গুলজারকে। একত্রে কাজ না করতে পাড়ার আফসোস এখনও ভুলতে পারেননি ‘বসকিয়ানা’র বস।
প্রবাদ হয়ে যাওয়ার মতোই আখ্যান। সত্যজিৎ চেয়েছিলেন ‘গুগাবাবা’র হিন্দি ভার্সান করতে। ছবির স্ক্রিপ্ট ও গান নিয়ে কথা বলতে ডেকেছিলেন গুলজারকে। প্রথম দিনের দেখা হওয়ার সেই মুগ্ধতা এখনও গুলজার সাহেবের মনের আকাশে মাধুর্য ছড়ায়।