নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র জীবদ্দশায় কোনওদিন প্রস্রাবের সমস্যার সম্মুখীন হননি এমন মানুষ বিরল। এই সমস্যা যেমন নানাবিধ তেমনি তার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে কঠিন প্রাণঘাতী অসুখ যা আমরা বিশ্বাসও করতে পারি না। সামান্য উপসর্গ কোনও দুরারোগ্য রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে। ঠিক কী কারণে এমনটা হতে পারে, আর সেক্ষেত্রে কীভাবে প্রতিরোধ করবেন, পরামর্শ দিচ্ছেন ডা. পিনাকী মুখোপাধ্যায় (নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ, নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক)।
আড়ালে কিডনি না কি আরও কিছু
১) প্রস্রাবের সমস্যার প্রধান কারণ হল কিডনি, মূত্রনালি, মুত্রাশয়ের অসুবিধা। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেটের সমস্যা।
২) এছাড়া মানসিক কারণ ও শরীরের অন্যান্য সিস্টেমের ত্রুটি বিচ্যুতির জন্যেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
৩) প্রোস্টেটের সমস্যা, কিডনিতে পাথর ও মুত্রনালির সংক্রমণ এবং কিডনি ও মুত্রাশয়ের ক্যানসার, মধুমেহ ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস, হরমোন জনিত সমস্যা, কিডনির প্রাথমিক অসুখ বা কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও এই সমস্যার কারণ হতে পারে।
৪) বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রোস্টেটিক হাইপারপ্লাসিয়া বা প্রোস্টেট বৃদ্ধি বেশি দেখা যায়। বর্ধিত প্রোস্টেট মূত্রনালির উপর চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন উপসর্গ ঘটায়। অনেক সময় পেটে ব্যথা, সংক্রমণ, প্রস্রাবে রক্তক্ষরণ কিডনি বা মূত্রনালির পাথরের প্রাথমিক উপসর্গ হতে পারে।
৫) আরও একটি পরিচিত সমস্যা হল মূত্রনালির সংক্রমণ (UTI)। মহিলাদের মধ্যে বেশি হলেও পুরুষ এবং শিশুদের ক্ষেত্রেও হতে পারে। তবে যেটা জানা নেই, তা হল এই সংক্রমণ কিডনিকেও সংক্রমিত করতে পারে এবং পরিস্থিতিকে আরও জটিল করতে পরে। তাই সময়ে চিকিৎসা শুরু করা দরকার।
৬) আরও একটি বহুল সমস্যা হল 'প্রস্রাবের অসংযম' অর্থাৎ প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা। বয়স্ক ব্যক্তিদের এটা বেশি হলেও সব বয়সেই বিভিন্ন কারণে হতে পারে। লাইফস্টাইল, অতিরিক্ত মদ্যপান, কফি/কার্বোনেটেড পানীয়ের ব্যবহার, সংক্রমণ, কোষ্ঠকাঠিন্য, প্রোস্টেট বৃদ্ধি বা প্রোস্টেট ক্যানসার ও তার চিকিৎসা, মহিলাদের মেনোপজের সময় হরমোনের পরিবর্তন, গর্ভাবস্থায় প্রস্রাবের বেগের পরিবর্তন হতে পারে। কিছু কিছু নার্ভের অসুখ রয়েছে যেগুলো মুত্রাশয়ের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে প্রভাবিত ও বিঘ্নিত করে। পার্কিনসন্স ডিজিজে আক্রান্তরা এই সমস্যার শিকার।
৭) ডায়াবেটিস রোগীদের বিভিন্ন রকমের প্রস্রাবের সমস্যা হতে পারে। সংক্রমণ, অসংযম, ফেনার মতো প্রস্রাব (প্রোটিন
নিঃসরণ), ঘনঘন প্রস্রাব, বেশি প্রস্রাব, প্রভৃতি উপসর্গ প্রায়শই দেখা যায়।
৮) মূত্রাশয় অথবা কিডনিতে টিউমার বা ক্যানসার বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে আসতে পারে। যন্ত্রণা নেই অথচ প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তক্ষরণ তাদের মধ্যে অন্যতম।
৯) মূত্রনালির জন্মগত কিছু সমস্যার জন্য বাচ্চাদের ঘন ঘন সংক্রমণ এবং ডবল ভয়েডিং-এর মতো প্রস্রাবের সমস্যা থাকতে পারে। এগুলো রিফ্লাক্স ডিজিজের অন্তর্গত। অনেক ক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।
১০) বিশেষ কিছু হরমোন, জিনগত সমস্যা এবং ওষুধ প্রস্রাবের সমস্যার কারণ হতে পারে।
১১) সাইকোজেনিক পলিইউরিয়া, রাত্রে বিছানায় প্রস্রাব করার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই মানসিক কারণ প্রধান কারণ হিসাবে পরিগণিত হতে পারে।
নির্ধারণের উপায় কী?
এই ধরনের সমস্যায় দ্রুত রোগ নির্ণয় খুবই জরুরি। বহু ক্ষেত্রে আগে রোগ ধরা পড়লে এবং সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব এবং কিডনির ক্ষতি থেকে বাঁচা সম্ভব। রক্তপরীক্ষা, রুটিন ইউরিন টেস্ট, এক্স-রে কালচার, আলট্রাসোনোগ্রাফি, MCU, IVP, RGU, সিটি স্ক্যান, এম আর আই, ইউরোফ্লোমেট্রি, ইউরো ডায়নমিক স্টাডি সিস্টোস্কোপি, কিছু ক্ষেত্রে নিউক্লিয়ার স্ক্যান, পেট (PET) স্ক্যান প্রয়োজন হতে পারে। তবে কোন অসুখে কোন টেস্ট আগে করাতে হবে তা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতোই করতে হবে।
সমাধান সূত্র
প্রস্রাবের বিভিন্ন সমস্যার পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সার্জিক্যাল আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ওষুধের দ্বারাই সমাধান সম্ভব। কিডনিতে বড় পাথর, টিউমার বা দীর্ঘস্থায়ী প্রোস্টেটের সমস্যা এবং মূত্রনালির বিশেষ কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে। তবে মুত্রাশয় সংক্রমণ, প্রস্রাবের অসংযম, ডায়াবেটিস বা হরমোন জনিত সমস্যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওষুধের মাধ্যমেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘতর আন্টিবায়োটিক কোর্স (যেখানে বারবার সংক্রমণ), ইস্ট্রোজেন থেরাপি (মেনোপোজ পরবর্তী পর্যায়) বা কিছু শরীর চর্চা (পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ), কেজেল (KEGEL) এক্সারসাইজ, টয়েলেট ট্রেনিং খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
প্রতিরোধ করতে হলে
আগে থেকে সচেতনা সবক্ষেত্রেই ভালো। পরিবারে কারও কিডনির অসুখ, ডায়াবেটিস বা হাইপার টেনশন থাকলে প্রথমেই পরীক্ষা করে নিতে হবে এবং ধরা পড়লে নিয়মিত চিকিৎসায় থাকতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণ এই অসুখ প্রতিরোধেও কার্যকর। নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করলে ভালো। সুষম খাদ্য এবং পরিমিত জলপান করুন। মদ্যপান, ধূমপান বর্জন করতে হবে। অতিরিক্ত কার্বোনেটেড তরল, ক্যাফিন জাতীয় পদার্থ, ব্যথা কমানোর ওষুধ (NSAID) চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা চলবে না। যাদের ক্ষেত্রে প্রায়শই মূত্রাশয়ে সংক্রমণ হয় তাঁদের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌনাঙ্গ পরিষ্কার রাখা, সহবাসের পর মূত্রত্যাগ, মলত্যাগের পর পিছন থেকে সামনের দিকে পরিষ্কার না করা, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সঠিক নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
ভয়ের কারণ
প্রস্রাবের সাধারণ সমস্যা কিছু দুরারোগ্য রোগের কারণ হতে পারে যেমন নিউরোজেনিক ব্লাডার, ব্লাডার এক্সট্রফি, ইনটারস্টিসিয়াল সিসটাইটিস এক্টোপিক ইউরেটার, ব্লাডার ক্যানসার প্রভৃতি। তাই কোনও সমস্যাকেই ফেলে রাখবেন না। দ্রুত চিকিৎসা করুন। না হলে ঝুঁকি আপনারই।
