মাঘের ভরা বিয়ের মরশুমে শহরের নানা বিয়েবাড়িতে যদিদং হৃদয়ং মন্ত্র আওড়াচ্ছে সাহেব-মেমরা। লিখছেন রুদ্রনীল ঘোষ।
ছোটবেলা থেকেই আমার ক্রিকেট খেলতে ভাল লাগে না। কিন্তু টিভিতে ক্রিকেট দেখতে ভাল লাগত। এখনও লাগে। কারণ আমি অবিবাহিত। অস্ট্রেলিয়ায় খেলা হচ্ছে। মাঠের উপর দিয়ে সাদা-সাদা বক উড়ছে। আর কিছু গরিব মেয়ে মাঠের ঘাসে শুয়ে আছে। তাদের গায়ে ছোট ছোট সব পোশাক। কারণ তাদের মায়েরা সব জামাকাপড় জলকাচা করে দিয়েছে। আমি শুধু ভাবতাম কখন আমাদের দেশের ব্যাটসম্যান চার মারবে, আর ওই গরিব মেয়েদের পাশ দিয়ে বল বাউন্ডারি পেরোবে। আর সেই দৃশ্য বারবার রিপ্লে হবে!
এই গরিব মেয়েরা ছিল আমার কাছে প্রথম বিদেশভ্রমণ!
তারপর আমায় বিদেশ ঘোরাল সিপিএম। আমার বাড়ির সবাই তখন সিপিএম করত। তাই বাড়িতে যে সব ম্যাগাজিন আসত, তাতে থাকত চিন, ভিয়েতনাম আর কিউবার কথা। তখন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক মতাদর্শ। আমেরিকা মানে একটা বুর্জোয়া দেশ। সে সব ম্যাগাজিনে মহিলাদের নাক আর চোখের ফুটো বাদ দিয়ে আর কিচ্ছু দেখা যেত না। আর থাকত ইগলু, স্লেজ আর বরফ। ছোটবেলায় এই কারণে পশ্চিমবঙ্গের সিপিএমের উপর ভীষণ রাগ ছিল। আমাকে ‘সিন্ধুপারের বিদেশিনী’দের দেখাতে পারেনি।
একটু বড় হতে আমায় প্রথম ‘বিদেশিনী’ চেনাল অ্যাডাল্ট ছবি। বিদেশের রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রামে, টেবিলে, পার্কে, ময়দানে দু’জনে মিলে দারুণ সব খেলা হয়। আমার যৌবনে বিপ্লব এল। আরিব্বাস! একজন ‘খুল যা সিমসিম’ বলছে তো আরেকজন বলছে ‘চিচিং ফাঁক’!
একটু বড় হতেই সব ভুল ভেঙে গেল। বুঝলাম সব মিথ্যে! সারা বিশ্বে কোনও দেশে এভাবে ‘লীলা খেলা’ খেলতে দেয় না। সব গালগল্প!
তারপর ইন্টারনেট এল। ফেসবুক এল। বিশ্বজুড়ে সম্পর্কের কালচারাল কমিটি তৈরি হল। শিক্ষায় এমবিএ পাস করল, মেম বিয়ে শুরু করল। শুধু মেম নয়। সাহেব বিয়েও। তারপর এরকম বিয়ে ‘টেরেন্ড’ হল! দেখবেন, ভাতে ঘি মাখিয়ে খেলে কেউ ফিরে তাকাবে না। কিন্তু কেউ এক চামচ মার্জারিন রাখুক সাদা গরম ভাতে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড়বড় করে পাশেরজন তাকাবে। বাঙালির ‘কই আমার তো হল না’ এটা চিরকাল থাকবে। তাই যারা মেম-সাহেবদের বিয়ে করছেন, এসবে বেশি পাত্তাফাত্তা দেবেন না।
[ আরও পড়ুন: ‘কেদারা’র পর ‘বিসমিল্লাহ’, ইন্দ্রদীপের ছবিতে প্রথমবার জুটি বাঁধছেন ঋদ্ধি-শুভশ্রী ]
মুম্বইতে এরকম বিয়ে আকছার হয়। বাঙালিরা সবে সবে ধরেছে। আসলে, আমরা তো একটু কম বাজেটের। তাই সব দেরিতে হয়। আরেকটা ব্যাপারও আছে, বাঙালিরা বুঝতে পারে না বিয়ে করতে গিয়ে ডলারে কথা বলবে না টাকায়!
আমি এ ধরনের বিয়ের একটা ডাকনাম দিয়েছি। ‘জেব্রা বিয়ে’। পিঁড়িতে একজন ফর্সা ধবধবে। আরেকজন একটু কালো (ভারতীয়রা সাধারণত ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা তো হয় না)। আর তারপর জন্ম নেবে একটা মনুষ্য প্রাণী। একটা কিউট ‘জেব্রা’!
আমার কিন্তু ‘জেব্রা বিয়ে’-র পাত্রপাত্রীর কথা ভাবলে ভীষণ মায়া হয়। কনের টেনশন শুরু হবে ঠিক পিঁড়িতে বসবার পর। একবার ভাবুন, উঁচু পিঁড়িতে বসিয়ে মেমকে চাগিয়ে তুলবে চারজন। তার তো পিলে চমকে যাবেই। তার উপর পাশ থেকে প্রচুর মহিলা এমন এক আওয়াজ করছে, যাকে বাংলায় বলে ‘উলুধ্বনি’। কিন্তু মেম বুঝবে এই আওয়াজ সে শেষ শুনেছিল আফ্রিকান সাফারিতে চিতাবাঘ শিকারের সময়। উলু শুনে মেমের চমকে ওঠা নিশ্চিত। ভাববে সেও কি শিকার হচ্ছে? আমি বিশ্বাস করি মেমসাহেব ওয়াশরুম যাওয়ার নাম করে গুগল সার্চ করবে-‘হোয়াট ইজ উলু উলু’!
জনস্বার্থে আরেকটা কথা বলি, ফুলশয্যার খাট রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে সাজাবেন না। থেঁতলে যাওয়া রজনীগন্ধার গন্ধ কিন্তু মারাত্মক। পার্টনারকে জিজ্ঞেস করে নিন প্রিয় ফুল কী। আমার যেমন থেঁতলানো গ্যাঁদাল পাতার গন্ধ খুব ভাল লাগে। আপনার তো আর লাগবে না। অতএব, আপনারা যখন যুগ্ম সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন, একটা বৈঠক সেরে ফেলুন। পারস্পরিক পছন্দ জানাটা আবশ্যিক। নাহলে সরকার পড়ে যেতে বাধ্য।
আর যা ভেবে আমার ‘মায়ার বাঁধন’ ছিঁড়ে যায় তা হল, বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলায় কনের বাপেরবাড়ি যাওয়ার বিষয়টাই বা কী হবে কিংবা জামাইষষ্ঠীর দিন বিলেতি পাত্র ল্যাংড়া আমের চোঁচ কীভাবে বেছে খাবে?
ভেবে দেখেছি, দু’দেশের সংস্কৃতি মিশে যেন জগাখিচুড়ি হয়ে যায় তার জন্য একটা উপায় দিচ্ছি। বিয়ের মেনুতে এক প্লেটে নলেনের রসগোল্লা থাকলে সঙ্গে চেরি থাকতে হবে। বারুইপুরের পেয়ারার পাশে, স্টিকার মারা ‘ইমপোর্টেড অ্যাপল’ লেখা থাকতেই হবে। লটে চচ্চড়ির পাশে গ্রেভি টুনা মাস্ট! বাঙালি আটপৌরের পাশে হালকা বিলিতি ফিল! দু’পক্ষই যেন খাবার প্লেটে সংস্কৃতির আদানপ্রদানে সন্তুষ্ট হয়।
আমি এরকম বিয়ের আমন্ত্রণ এখনও পাইনি। তবে সুখবর আসন্ন। আমার বন্ধু পরমের (পরমব্রত) বিয়েতে আমি জীবনের প্রথম ‘জেব্রা’ বিয়ে অ্যাটেন্ড করব। পরমের প্রেমিকা, ইকা বিদেশি। পরম কিন্তু দু’দিকেই আছে।
ও কোট-প্যান্ট পরে চার্চে গিয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে আবার কোট খুলে স্যান্ডো গেঞ্জির পাশে ‘চাটুজ্জে’ পৈতেও ঠিক করে নেবে। ও দু’দিকেই ব্যাটিং করতে পারে। পরম দোলনা স্কুলে পড়েছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে আবার ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতেও পড়েছে। আমরা মানে পাত্রপক্ষ পরমকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত। ও বিদেশে এমবিএ করতে যায়নি কিন্তু মেম বিয়ে করে ফেলবে!
পরম আমার প্রথম বন্ধু যার প্রেমিকা বিদেশি। তার উপর আমস্টারডামের মেয়ে। হেব্বি ব্যাপার! প্রথমদিকে ভাবতাম, কেমন হবে? ইকা কি মিশতে পারবে আমাদের সঙ্গে? কী বলতে কী বুঝবে?
আমরা তো আল্টিমেটলি ফচকে টাইপের। তারপর দেখলাম আমার সব ধারণা ভুল।
ইকা পরমের থেকে বেশি বাঙালি। ‘জেব্রা’ বিয়েতে মন্ত্র উচ্চারণে ইকার এক ফোঁটা অসুবিধে হবে না কারণ ও আমার থেকেও ভাল বাংলা বলে। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে একমাত্র আমি ঠিকঠাক ইংরেজি বলতে পারি না এবং এ কারণেই ইকা কষ্ট করে বাংলা বলা শিখেছে। ফুল ক্রেডিট গোজ টু মি! বিয়েতে আমি নিতবর হব কি না জানি না। তবে নিতবরের প্রার্থী হিসেবে হাইটের নিরিখে আমি এগিয়ে থাকব।
[ আরও পড়ুন: বড়পর্দায় আসছে সৌমিত্রর বায়োপিক, পরিচালনায় পরমব্রত ]
পরমের ‘জেব্রা’ বিয়েতে আমার অনেক কাজ। বেনারসি শাড়ি আমি নিজে পরিনি। তবে চাগিয়েছি। ভীষণ ভারী এবং খরখরে। রুপো-টুপো দেওয়া থাকে বলে গায়ে পরলে কুটকুট করে। বান্ধবীদের বিয়েতে গিয়ে দেখেছি, লোকজন একটু অন্যদিকে সরতে কনে, কনুইয়ের কাছে একটু চুলকে নিচ্ছে। আমি ইকাকে আগেভাগে ‘কুটকুট’ বিষয়ক যাবতীয় তথ্য দিয়ে ওকে সতর্ক করতে চাই। আমি জানি পরম-ইকার বিয়েতে বাসর রাত জাগা নিয়ে একটা অন্যরকম টেনশন চলবে। কে কী গান ধরবে, কী করবে বোঝা মুশকিল। কেউ হয়তো বলল, “বউদি বউদি একটা গান ধরুন তো? (ইংরেজিতে)” আমি জানি পরম নিজে গান ধরার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমি ওকে গাইতে দেব না। পরমের গান শুনে শুনে আমার কান পচে গেছে। ঠিক করেছি ইকাকে আমি দুটো বাংলা ‘বউদি সংগীত’ শিখিয়ে রাখব–‘আর কত রাত একা থাকব’ এবং ‘এই মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি’।
পরমের সঙ্গে আমার ভীষণ ঝগড়া হয়। কিন্তু ঠিক করে নিয়েছি বিয়ের আগে অবধি কোনও ঝগড়া নয়। ইকা-পরমের ‘জেব্রা’ বিয়ে আমি হেলায় হারাতে চাই না।
ওয়েটলেস উপহার
আজকাল বাঙালি বর-কনেদের বেশির ভাগই রাজ্যের বাইরে থেকে বিয়ে করতে আসে। বিয়ে সেরে ফিরে যায় নিজের শহর বা চাকরির দেশে। এদের ফুলদানি বা ডিনার সেট দিয়ে লাভ নেই। তাহলে? কফিহাউসের ৩ টিপস।
টাকা
পুরনোপন্থীরা কিন্তু-কিন্তু করবেন। তবে এখনকার বর-কনের ফার্স্ট প্রেফারেন্স টাকা। উপহার পছন্দ না হওয়ার ঝুঁকি নেই। সুটকেসের বদলে ওয়ালেটের ওজন বাড়লে কারও আপত্তিও নেই। সময়মতো নিজেদের পছন্দের কিছু কিনে নেওয়ার অবকাশ আছে। অনেকে উপহারের টাকাগুলো হানিমুন ফান্ডেও ঢেলে দেন।
গিফট কুপন
শপার্স স্টপ, প্যান্টালুন্স বা হোমটাউনের মতো বড় স্টোরে নানা অঙ্কের গিফট কুপন পাওয়া যায়। সেগুলোও উপহার হিসেবে খুব ভাল। বিশেষ করে দেশের অন্য শহরেও যে স্টোর আছে, সেখানকার কুপন দিলে বর-কনে বিয়ের ঝামেলা মিটিয়ে শান্তিতে পছন্দমতো শপিং করতে পারবেন।
নেটফ্লিক্স সাবস্ক্রিপশন
টানটান থ্রিলার বা গভীর প্রেমের ফিল্ম– নবদম্পতির একত্রে সময় কাটানোর দারুণ রসদ। এক বছরের নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম অথবা হটস্টারের সাবস্ক্রিপশন যদি তাদের উপহার দেন, কেল্লা ফতে।
The post বিদেশিকে বিয়ে? মেনু থেকে ফুলশয্যার খাট, মেনে চলুন রুদ্রনীলের টিপস appeared first on Sangbad Pratidin.