shono
Advertisement

ক্রমশ বাড়ছে মাখনার জনপ্রিয়তা, জেনে নিন চাষের পদ্ধতি

মাখনা চাষে কী সমস্যা হতে পারে?
Posted: 04:14 PM Nov 22, 2023Updated: 04:14 PM Nov 22, 2023

মাখনা পদ্মের মতো জলজ উদ্ভিদ। গোলাপি বর্ণের ফুল এবং কাঁটাযুক্ত বলের মতো সবুজ ফল হয়। প্রতিটা ফলে ১০০ থেকে ২০০ টা বীজ থাকে। বীজের শাঁস খাদ্য হিসেবে গৃহীত হয়। মাখনা এক উন্নত মানের ‘ড্রাই ফ্রুট’ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলে অনায়াসে মাখনা খেতে পারেন। বিকল্প ফসল হিসেবে মাখনাকে বেছে নিয়েছেন অনেক চাষি। বর্তমান সময়ে এই মাখনা চাষের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শস্য বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক তাসিকুল ইসলাম।

Advertisement

মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধান চাষের প্রাধান্য দেখা গেলেও বিগত কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে চাষিদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ব্যাকটেরিয়াজনিত ধসা ( Bacterial leaf blight), টুংরো রোগ (Tungro virus), বন্যার প্রকোপ প্রভৃতি ঘটনা এখন প্রায়শই এই জেলার বিভিন্ন অংশে দেখা যায়। বিশেষ করে হরিশ্চন্দ্রপুর এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকাজুড়ে তার প্রাদুর্ভাবটা একটু বেশি। এই সমস্ত কারণে এখানকার চাষিরা শুধুমাত্র ধান চাষের উপর নির্ভরশীল না থেকে বিকল্প ফসল হিসেবে মাখনাকে বেছে নিয়েছেন। বর্তমান সময়ে এই মাখনা চাষের জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মাখনা আসলে কী?
মাখনা পদ্মের মতো জলজ উদ্ভিদ, এর বিজ্ঞান সম্মত নাম ইউরিয়েল ফেরক্স (Euryale ferox) যা জলজ পদ্মের গোত্রে (Nympheaceae) অন্তর্ভুক্ত। এটি ফক্সনাট (Fox nut) নামেও পরিচিত। বিশালাকার গোলাকৃতি ভাসমান সবুজ পাতার উভয়পৃষ্ঠ কাঁটাযুক্ত, পাতার নীচের দিক গাঢ় বেগুনি বর্ণের। গোলাপি বর্ণের ফুল এবং কাঁটাযুক্ত বলের মতো সবুজ ফল হয়। প্রতিটা ফলে ১০০ থেকে ২০০ টা বীজ থাকে। বীজ শক্ত কালো খোসাযুক্ত হয়। বীজের মধ্যে থাকা পেরিস্পারম ( Perisperm) বা শাঁস খাদ্য হিসেবে গৃহীত হয় যা দেখতে সাদা এবং স্টার্চ প্রকৃতির।

মাখনার ব্যবহার
মাখনা এক উন্নত মানের ড্রাই ফল (Dry fruit) হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবায় অনায়াসে মাখনা খেতে পারেন। মাখনার শাঁসে (Perisperm) ৯.৭% প্রোটিন, ০.১% ফ্যাট, ০.৫% খনিজ পদার্থ এবং ৭৬.৯% শর্করা থাকে। এছাড়াও এর মধ্যে আয়রন, ক্যারোটিন এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ থাকে। মাখনার খই বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ক্ষীর, সিমাই, হালুয়া ইত্যাদি তৈরিতেও মাখনার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মাখনা রায়তা, ডাল মাখানির অন্যতম উপাদান হল মাখনা। ঘিয়ে ভাজা মাখনা স্নাক্স হিসেবে খাওয়া যায়। বিভিন্ন রোগের ওষুধ যেমন ডায়েরিয়া, কিডনি জনিত সমস্যা, বাতের সমস্যা প্রভৃতি তৈরিতেও মাখনার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বস্ত্রশিল্পের স্টার্চ তৈরিতে মাখনা কাজে লাগে। মাখনার উপজাত পদার্থগুলি গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির উন্নতমানের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

[আরও পড়ুন: রুখাশুখা পুরুলিয়ায় কৃষিবিপ্লব, পুকুরে কই-পাবদা-চিতল-গলদা চিংড়ি চাষ]

চাষের পদ্ধতি
গতানুগতিক পদ্ধতি অনুযায়ী মাখনা ৪-৫ ফুট গভীরতার জলাশয়ে চাষ হয়। তবে মালদহ জেলার বিভিন্ন অংশে নীচু ধানের জমিতে ১ ফুট গভীরতায় মাখনা চাষ করা হয়। জমি হালকা খনন করে ও জল জমিয়ে মাখনা চাষ হয়।

চারা তৈরি
এক একর মাখনা চাষের জন্য সাধারণত ২০০ বর্গ মিটার জায়গায় চারা তৈরি করা হয়। চারা তৈরির জন্য ২-৩ বার গভীর চাষ দেওয়া হয়। জমি তৈরির সময় একর প্রতি ৮০-৯০ কেজি ইউরিয়া, ১৪০-১৫০ কেজি সুপার ফসফেট এবং ২৫-৩০ কেজি পটাশ প্রয়োগ করা হয়। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে ৮ কেজি বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং জমিতে ১ ফুট মতো জল দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তবে সাধারণত জমিতে আগের বছরের ঝরে পরে থাকা বীজ থেকে চারা তৈরি হয়ে যায়।

চারা রোপণ
রোগমুক্ত স্বাস্থ্যবান চারা ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ১মি x ১মি বা ১.২৫মি. x ১.২৫মি. দূরত্বে মূল জমিতে রোপণ করা হয়। মূল জমি তৈরির জন্য ২-৩ বার গভীর চাষ দিয়ে মই দিয়ে জমি লেভেল করা হয়। সার হিসেবে একর প্রতি ৭০-৮০ কেজি ইউরিয়া, ৫০-৬০ কেজি ডিএপি এবং ২৫-৩০ কেজি পটাশ প্রয়োগ করা হয়। সঙ্গে ৫-৬ টোন গোবর সারও দেওয়া হয়। জলজ পোকা এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ফিউরাডন ৮-১০ কেজি বা ক্লোরপাইরিফস ১০% GR ৪-৫ কেজি একরে দেওয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন অনুখাদ্য, সামুদ্রিক আগাছা নির্যাস ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়।

ফলন
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে গাছে গোলাপি বর্ণের ফুল দেখা যায়। ফুল আসার ৩০-৩৫ দিন পরে ফল পরিপক্ক হয়। পরিপক্ক হওয়ার পর ফল ফেটে যায় এবং বীজগুলি জলে ভাসতে থাকে। ২-৩ দিন এভাবে থাকার পর সেগুলি জলের নীচে ডুবে যায়। ভাদ্র- আশ্বিন মাসে জলের তলায় অনেকগুলি বীজকে কাদাসহ বেশ কয়েক জায়গায় একত্রিত করা হয় এবং গঞ্জা (Ganja) নামক বাঁশের তৈরি যন্ত্রের সাহায্য সেগুলি জল থেকে তোলা হয়। এরপর ওই শিঙের মতো যন্ত্রের মধ্যে (গঞ্জা) বীজগুলিকে ভালভাবে ঘষে পরিস্কার করা হয়। ফলন হিসেবে একর প্রতি ৯০০-১২০০ কেজি বীজ পাওয়া যায়।

খই তৈরি
বীজগুলিকে প্রথমে রোদে শোকানো হয়। তারপর সেগুলি মাটির পাত্র বা লোহার কড়াইয়ে ২৫০- ৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ভাজা হয়। ৫-৬ মিনিট অনবরত নাড়তে থাকতে হয় এবং মাখনার জলীয় অংশের পরিমাণ ২০ শতাংশে আনা হয়। এরপর বীজগুলিকে ২-৩ দিনের জন্য ঘড়ের তাপমাত্রায় রাখা হয়। ২০০- ২৫০ গ্রাম বীজ লোহার কড়াইয়ে ২৯০-৩৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় আবার ভাজা হয়। এইভাবে ২-৩ টি কড়াইয়ে একটির পর আর একটিতে স্থানান্তরিত করা হয়। শেষ কড়াইয়ে ভাজার সময় ফটাস ফটাস শব্দ হলে ওই গরম বীজ তুলে নিয়ে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে শক্ত বীজের খোসা ফেটে খই বেরিয়ে আসে। ১০০ কেজি মাখনা বীজ থেকে ৪০- ৪৫ কেজি খই পাওয়া যায়।

আনুমানিক মুনাফা
বর্তমান মাখনা বীজের বাজার মূল্য ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা প্রতি কুইন্টাল। এক একরে আয়= ১৮০০০০- ২০০০০০ টাকা ( গড় ফলন ১০ কুইন্টাল ধরা হল)। এক একরে খরচ= ৩০০০০- ৫০০০০ টাকাএক একরে লাভ= ১২০০০০- ১৫০০০০ টাকা। বীজ থেকে খই করে বিক্রি করলে লাভের পরিমাণ আরও কিছু বেশি হয়।

মাখনা চাষে সমস্যা

  • চাষের শুরু থেকে শেষ অবধি জমিতে জল জমিয়ে রাখতে হয়।
  • মাখনা পরিপক্ক হতে প্রায় ৮-৯ মাস সময় লাগে এবং সারাবছর জলে ডুবে থাকায় মাটির গঠনের বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে। তাই সেই জমিতে অন্য কোনও ফসল চাষ প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।

  • পাতা খেকো লেদা জাতীয় পোকার খুব সমস্যা দেখা যায়।
  • জমি থেকে মাখনা বীজ তোলাটা খুব জটিল প্রক্রিয়া এবং প্রচুর সুদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।
  • বীজ থেকে খই বার করতে প্রচুর সময় লাগে এবং সেটা খুব কষ্টকর প্রক্রিয়া। এসব বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও লাভের পরিমাণটা অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি থাকায় এর চাষ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

[আরও পড়ুন: আলুবীজ উৎপাদনে স্বাবলম্বী হতে পেরুর হাত ধরল বাংলা, উত্তরবঙ্গে তৈরি হচ্ছে নতুন টিস্যু কালচার ল্যাব]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement