সেপ্টেম্বর মাসে জিএসটি সংগ্রহর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। জিএসটি বৃদ্ধির হার ২৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌঁছেছে। আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে জিএসটি সংগ্রহ বেড়েছে মাত্র ২.৩ শতাংশ। এবারের উৎসবে ব্যবসা-বাণিজ্য কতটা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
অশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম আবার যে হারে বাড়তে শুরু করেছে, তাতে যে কোনও মুহূর্তে সরকার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। ভোটের দিকে তাকিয়ে সরকার রান্নার গ্যাসের দাম ২০০ টাকা কমিয়েছে। জ্বালানির দাম বাড়তে থাকলে সেটাও কমিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না, তা বলা যাচ্ছে না।
বঙ্গে এবার আমরা বিলম্বিত বর্ষা পেলেও, দেশের অধিকাংশ অঞ্চল থেকে মৌসুমি বায়ু বিদায় নিতে শুরু করেছে। বর্ষার বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। এই উৎসবের দিকে তাকিয়ে থাকে শিল্প-বাণিজ্য মহল। কিছুদিন আগে বণিকসভা ‘অ্যাসোচেম’ একটি তথ্য দিয়ে দেখিয়েছিল, শুধুমাত্র দুর্গাপুজো উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। এই সময়টা বাংলায় যেমন দুর্গাপুজো, তেমন অন্যান্য রাজ্যেও প্রধান উৎসবের সময়। দীপাবলি উদ্যাপিত হয় দেশের প্রায় সব রাজ্যেই। ফলে আগামী দু’-তিন মাসে গোটা দেশে কী পরিমাণ ব্যবসা-বাণিজ্য হবে, তা সহজেই অনুমেয়। ভোগপণ্যর উৎপাদকরা তাদের পণ্য বাজারে আনার জন্য সবসময় এই সময়টাকেই বেছে নেয়। এই সময়ই সাধারণত সবাই খরচের মেজাজে থাকে।
কিন্তু, এবারের উৎসবে ব্যবসা-বাণিজ্য কতটা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে জিএসটি সংগ্রহর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, জিএসটি বৃদ্ধির হার ২৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন বিন্দুতে পৌঁছেছে। আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে জিএসটি সংগ্রহ বেড়েছে মাত্র ২.৩ শতাংশ। জিএসটি সংগ্রহর পরিমাণ অবশ্যই ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচালের একটি সূচক। ব্যবসা-বাণিজ্য যত ভাল হবে, তত পণ্য পরিষেবা করের সংগ্রহ বাড়বে। এটা বোঝার জন্য অর্থনীতির জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। বিক্রয় করের জমানা থেকে যখন দেশ পণ্য পরিষেবা কর তথা জিএসটি-র জমানায় যাচ্ছিল, তখন জানা যায়, গড়ে প্রতি বছর রাজ্যগুলির বিক্রয় কর থেকে আয় বৃদ্ধি পায় ১৪ শতাংশ হারে। জিএসটি জমানায় এসে বৃদ্ধির এই হার এখনও ধরা যায়নি। কিন্তু কোনও মাসে যদি জিএসটি থেকে আয় বৃদ্ধির হার ২-৩ শতাংশে নেমে যায়, তা হলে সেটা চিন্তার।
গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে ভারতের রফতানির পরিমাণ কমছে। অশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বিশ্ববাজারে আবার ঊর্ধ্বমুখী। জ্বালানির দাম বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমুখী হলেই দেশের আমদানি খাতে খরচ বাড়ে। বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে তখন রফতানি বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনও পথ থাকে না। কিন্তু গত কয়েক মাসে রফতানি বাড়ার লক্ষণ নেই, বরং তা কমেই চলেছে। আমরা বস্ত্র, গয়না, জুতো ইত্যাদি যে সমস্ত শ্রমনিবিড় পণ্য বিদেশের বাজারে রফতানি করে থাকি, সেগুলির ক্ষেত্রে এখন তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে। এই ধরনের পণ্য উৎপাদনে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশের মতো দেশ দ্রুত এগিয়ে আসছে। চিন তো রয়েইছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এই দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারতীয় পণ্য এঁটে উঠতে পারছে না। ভারতের চেয়ে কম খরচে এইসব দেশ শ্রমনিবিড় পণ্যগুলি অনেক বেশি উৎপাদন করছে। আন্তর্জাতিক বাজারও এরা দ্রুত ধরে ফেলছে।
[আরও পড়ুন: পূজারি যোগ্য হলে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর একত্র আরাধনা সম্ভব, প্রমাণ করেছিলেন বিদ্যাসাগর]
রফতানি ধারাবাহিকভাবে কমে যাওয়াটা খুবই উদ্বেগের। এক্ষেত্রে দেশের সরকার সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা করছে কি না, তাও বোঝা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। কিন্তু, সেই প্রকল্পে আদৌ কোনও কাজ হচ্ছে কি না, তা দেখার কেউ নেই। গত ৯ বছরের অভিজ্ঞতা হল, মোদির সরকার অনেক বেশি চমকের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। যখন কোনও একটা প্রকল্প ঘোষণা করা হয়, তখন তাতে অনেক চমক থাকে। বিশেষত, নামকরণের ক্ষেত্রে একটা অভিনবত্ব আনা হয়। প্রকল্পটি নিয়ে প্রচারের ক্ষেত্রে একটা শোরগোল ফেলা হয়। কিন্তু, গোটাটাই একটা বিজ্ঞাপনী চমক হিসাবেই থেকে যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে গত ৯-১০ বছরে কোনও দেশি ব্র্যান্ডকে না দাঁড় করাতে পারা থেকেই স্পষ্ট, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ একটি চমক ছাড়া কিছু নয়।
কয়েকদিন আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে আরও একটি উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০২০-’২১ সালে গৃহস্থের সঞ্চয় ১১.৫ শতাংশ থেকে কমে
৫.১ শতাংশে নেমে এসেছে। ২ বছর আগের এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে সদ্য গত সেপ্টেম্বর মাসে। গৃহস্থের সঞ্চয় এইভাবে এক বছরে ৬.৪ শতাংশ কমে যাওয়া চিন্তার। মানুষের যখন আয় কমে, তখনই সঞ্চয় এতটা কমে। সঞ্চয়ের এই হ্রাস থেকে বোঝাই যাচ্ছে দেশের মানুষের সামগ্রিক আয় তলানিতে পৌঁছে যাচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যটি সামনে আসার পর অবশ্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের পক্ষ থেকে নানারকম সাফাই দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কোভিড পরবর্তী সময়ে গৃহস্থের খরচ বেড়েছে। সঞ্চয়ের পরিবর্তে গৃহস্থ বাড়ি, গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদ সংগ্রহর দিকে গুরুত্ব দিয়েছে। কোভিডের সময় যেহেতু ব্যাঙ্কের সুদ কমেছে, তাই গৃহস্থ সঞ্চয়ে আগ্রহ হারিয়েছে। সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছে, ২০২০-’২১ এবং ২০২১-’২২-এর মধে্য নির্মাণ শিল্পে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক থেকে গৃহঋণের পরিমাণও প্রচুর বেড়েছে। ২০১৯-’২০ থেকে ২০২২-’২৩-এর মধ্যে বিভিন্ন গৃহ ঋণদানকারী সংস্থার ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৭ গুণ। বাড়ি বানানো ছাড়াও অন্যান্য সম্পদেও গৃহস্থের লগ্নি এই সময়কালে বেড়েছে বলে কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি। সে-কারণে সরকার বলছে, গৃহস্থের সঞ্চয় কমে যাওয়ার তথে্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই।
অর্থমন্ত্রক যে সাফাই দিক না কেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা কখনও সম্ভব নয়। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির হাল যে ক্রমশ খারাপের দিকে চলেছে, তা বুঝতে কারও সমস্যা ঘটে না। মূল্যবৃদ্ধি ভয়ংকর হারে বেড়ে চলেছে। টাকার দাম পড়তির দিকে।
১ ডলার কিনতে এখন ৮৩ টাকার বেশি খরচ হয়। এক পাউন্ড কিনতে ১০০ টাকার বেশি খরচ হয়। ভারতের মুদ্রা যত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তত বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য আমাদের কাছে দামি হয়ে উঠছে। অশোধিত তেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম আবার যে-হারে বাড়তে শুরু করেছে, তাতে যে কোনও মুহূর্তে সরকার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। ভোটের দিকে তাকিয়ে সরকার রান্নার গ্যাসের দাম ২০০ টাকা কমিয়েছে। জ্বালানির দাম বাড়তে থাকলে সেটাও কমিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না, তা বলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে উৎসবের আগে অর্থনীতির হাল চিন্তাজনক। বুধবার থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতি সংক্রান্ত কমিটির দ্বিমাসিক বৈঠক শুরু হচ্ছে। এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে শিল্প-বাণিজ্যমহল। বৈঠকের পর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে অর্থনীতির প্রকৃত ছবিটা হয়তো আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরা হবে।
(মতামত নিজস্ব)