shono
Advertisement

ভারতের জেমস বন্ড! অস্ত্র নয়, স্রেফ মুখের কথায় থামান দাঙ্গা, গল্পকেও হার মানায় ডোভালের কীর্তি

পড়ুন 'সুপার স্পাই' ডোভালের রোমহর্ষক কীর্তির প্রথম পর্ব।
Posted: 08:33 PM Jun 17, 2023Updated: 08:46 PM Jun 17, 2023

বিশ্বদীপ দে: ‘দ্যাট লাস্ট হ্যান্ড নিয়ারলি কিলড মি।’ এই সংলাপ কার তা বন্ড ভক্তদের বলে দিতে হবে না। ড্যানিয়েল ক্রেগের জেমস বন্ড মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসে এমনই অবলীলায় নিজের বেঁচে যাওয়ার কথা শুনিয়েছিল। ‘ভারতের জেমস বন্ড’ কখনও এমন কথা বলেছেন কিনা জানা নেই। কিন্তু কেরিয়ারের একেবারে শুরু থেকে নিজের প্রাণের ঝুঁকি তিনি নিয়েছেন অজস্রবার। তবে বন্ডের মতো আগ্নেয়াস্ত্র নয়, মগজাস্ত্রই তাঁর আসল শক্তি। যার সাহায্যে দেশে-বিদেশে একের পর এক গোপন মিশনে অবিস্মরণীয় সাফল্যের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতের একমাত্র সুপার স্পাই। তিনি অজিত ডোভাল (Ajit Doval)। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীতে কাটিয়ে এই মুহূর্তে তিনি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা।

Advertisement

কেরিয়ারের ৭টি বছর কেটেছিল উর্দিতে। বাকি তিরিশটা বছর ধরে আন্ডার কভার এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন ইন্টেলিজেন্ট ব্যুরোর হয়ে। তাঁর সাফল্যের খতিয়ান হয়ে রয়ে গিয়েছে চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো সব ঘটনা। যা স্রেফ মনের খেয়ালে কল্পনা করে সাদা পাতায় লিখতে গেলেও দু’বার ভাবতে হত লেখককে। কখনও ভিখারি সেজে পাকিস্তানের রাজপথে বসে থাকা, কখনও খলিস্তানিদের ভিড়ে রিকশা চালক হয়ে ঢুকে পড়া, শত্রুপক্ষের ডেরায় ঢুকে স্রেফ কথার খেলায় তাদের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে দেওয়া… মনে হতেই পারে কোনও সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজের দুর্দান্ত থ্রিলিং স্ক্রিপ্ট!

২০০৫ সালে অবসর নেন ডোভাল। পরে ২০১৪ সালে তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)। এই পদে থেকে তিনি কী করেছেন তা হালফিলের অনেকেরই জানা। যার মধ্যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের কথা জানে না এমন কেউ নেই। কিন্তু সেই সাফল্যেরও ঢের আগে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীতে ডোভালের সাফল্যের কাহিনি বাজারচলতি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিকে হার মানায়! সেগুলির কথা না জানলে তাঁকে চেনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সেই রোমাঞ্চকর কাহিনির পাতাগুলি উলটে দেখা যাক তাহলে।

[আরও পড়ুন: নতুন করে হিংসা ছড়াল মণিপুরে, পুলিশের অস্ত্রাগার ভাঙচুর বিক্ষোভকারীদের!]

১৯৪৫ সালে উত্তরাখণ্ডে জন্ম ডোভালের। বাবা সেনা অফিসার মেজর গুণানন্দ ডোভাল। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী পড়ুয়া ছিলেন। ২২ বছরেই অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডোভাল প্রথমবার ইউপিএসসিতে বসেই উত্তীর্ণ হন। সুযোগ পান ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে। সেটা ১৯৬৮ সাল। কেরল ক্যাডারে এএসপি হিসেবে যোগ দেন ডোভাল। আর কেরিয়ার শুরুর বছর তিনেকের মধ্যেই সুযোগ পান নিজেকে প্রমাণ করার।

২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। কেরলের থালাসেরি গ্রামে স্রেফ গুজবের কারণে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে। ১৯৭২ সাল পড়তে না পড়তেই পরিস্থিতি আরও আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে। সেই সময় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে করুণাকরণ এমন এক পুলিশ আধিকারিককে খুঁজছিলেন যিনি এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারবেন। ততদিনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তরুণ, দুর্দান্ত স্মার্ট ও দক্ষ অফিসার ডোভালের যোগ্যতা ও দক্ষতার আঁচ পেয়ে গিয়েছেন। করুণাকরণ পর্যন্ত সেই খবর পৌঁছে গিয়েছিল। সেই সময় ডোভাল কোট্টেয়ামে পোস্টেড। তাঁকে বেছে নেওয়া হল থালাসেরি গ্রামের জন্য।

[আরও পড়ুন: বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরাচ্ছেন সাভারকর! পাটনার বৈঠকের আগে কংগ্রেসকে নিশানা উদ্ধবের]

আর সুযোগ পেয়েই যেন ‘ম্যাজিক’ দেখালেন ডোভাল। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গেই কথা বললেন তিনি। আর বেশ দ্রুতই বিষয়টিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ফেললেন। অশান্তি যে কেবল থেমে গেল তাই-ই নয়। দেখা গেল অশান্তি সৃষ্টিকারীরা তাদের লুঠ করা জিনিসপত্রও ফেরত দিতে প্রস্তুত! রাতারাতি পরিস্থিতি একেবারে আগের মতো নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল। রাজ্যের পুলিশ বাহিনী যা করতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিল, একা ডোভাল সেটাই করে দেখালেন! তাও মাত্র সাত দিনে। ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি।

দক্ষিণের কেরল থেকে উত্তরে দিল্লি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল ডোভালের এই অসামান্য কীর্তির কথা। যার সাহায্য়েই ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো তথা আইবি-তে ঢুকে পড়া। বছর সাতেকের পুলিশ সার্ভিসের কেরিয়ারে সবচেয়ে কমবয়সি আইপিএস হিসেবে পুলিশ পদকের পাশাপাশি পেয়েছিলেন ‘প্রেসিন্ডেন্ট পুলিশ’ পদক। আরও পরে ১৯৮৮ সালে তিনি পান কীর্তিচক্র। এতদিন পর্যন্ত এই পদক পেতেন কেবলই সেনা অফিসাররা। প্রথম পুলিশ আধিকারিক হিসেবে এই কীর্তি গড়েন ডোভাল।

আইবিতে থাকাকালীন প্রথম কিছুদিন সাধারণ অফিস ওয়ার্ক করতে হয়েছিল ডোভালকে। কিন্তু ক্রমেই আন্ডার কভার এজেন্ট হিসেবে একের পর এক সাফল্য তাঁকে করে তোলে সুপার স্পাই। যে কোনওদিন যা নিয়ে ছবি করার পথে হাঁটতে পারেন কোনও পরিচালক। এমন ‘মশলা’ হাতছাড়া করার লোভ সামলানো মুশকিল। কেবল পাকিস্তানেই তিনি থেকেছেন সাত বছর। স্পাইয়ের জীবন গোপনীয়। তবু সেই গোপন মিশনকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া কীর্তিকাহিনি জন্ম দিতে থাকে মিথের। এবার আমরা সেই কীর্তিগুলির কথা বলব।

কাউকে সঙ্গে নিয়ে নয়। একা একাই বেশির ভাগ ঝুঁকিপূর্ণ মিশনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন ডোভাল। পরে এসম্পর্কে বলতে গিয়ে (মহেশ দত্ত শর্মার লেখা ‘সুপারকপ এনএসএ অজিত ডোভাল’ নামের বইটি দ্রষ্টব্য) তিনি বলেন, ”আমি এভাবেই কাজ করতে চাইতাম। অনেক সময় ব্যাপারটাকে নেগেটিভ ভাবে দেখা হত। আবার অনেকে বিষয়টাকে ভাল উদ্দেশ্যেই দেখত। কিন্তু কেন আমি ‘সোলো অপারেটর’ হলাম, তার পিছনে একটাই কারণ ছিল। আসলে আমি নিজে নিজের পরিস্থিতিটা বুঝতে পারতাম। খামোখা অন্যদের কেন ঝুঁকির মধ্যে টানব?” সেই সঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন, প্রবল আত্মবিশ্বাসী থাকতে পারাটা এই ধরনের মিশনে সাফল্যের আসল কারণ। এক্ষেত্রে তাঁর জীবনের এক প্রধান মন্ত্র এই সংস্কৃত শ্লোক- ‘সংশয়াত্ম বিনাশয়তি’। অর্থাৎ নিজের সাফল্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দিহান থাকলে চলবে না। আর সেটাই তিনি করে গিয়েছেন আজীবন। নিজের উপর সামান্যতম সন্দেহও রাখেননি। যা করেছেন একাই করেছেন। সঙ্গী কেবল অদম্য আত্মবিশ্বাস।

গত শতকের সাতের দশকে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে শুরু হয়েছিল বিদ্রোহ। আলাদা রাষ্ট্রের দাবি উঠেছিল মিজোরামে। মিজো ন্যাশনাল ফন্টের অবিসংবাদী নেতা লালডেঙ্গা কার্যতই যেন ‘সমান্তরাল সরকার’ চালাচ্ছিলেন। ক্রমশই যা দিল্লির কপালে চিন্তার ভাঁজকে চওড়া করে তুলছিল। আইবি পরিকল্পনা করল, একজনকে পাঠানো হোক, যে কাছ থেকে ওই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। দায়িত্ব বর্তাল সদ্য বিবাহিত তরুণ ডোভালের উপরে। ভুল। তিনি নিজেই যেচে দায়িত্ব চেয়ে নিয়েছিলেন। বিক্ষোভের আগুনে গনগনে হয়ে থাকা মিজোরামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রাণ বাজি রেখে। মগজাস্ত্রে শান দিয়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যে ঢুকে পড়ে একেবারে লালডেঙ্গার ঘাঁটিতে পা রাখলেন ডোভাল।

তিনি জানতেন, লালডেঙ্গার আসল শক্তি তাঁর সাত কমান্ডার। সটান তাঁদের সঙ্গেই ভাব জমালেন। একে একে সাতজনের মধ্যে ছ’জনকেই সরকারের পক্ষে টেনে নিলেন নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে। ক্রমেই ‘বেচারি’ লালডেঙ্গা বুঝতে পারলেন খেলাটা তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। কেননা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে তাঁর ‘প্রাণভোমরা’। অগত্যা গুটিসুটি মেরে তিনি ভারত সরকারের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হলেন। শান্তি চুক্তির পরে মিজোরামে সাধারণ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হল। পরিস্থিতি হয়ে গেল একেবারে স্বাভাবিক। একই ‘ম্যাজিক’ ডোভাল দেখান সিকিমেও। সেকথা আগামী পর্বে।
(ক্রমশ)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement