নির্মল ধর: সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার ‘সংখ্যালঘু’ (Sankhalaghu Drama) গল্পটি লিখেছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। এ রাজ্যে এক দশক আগে রাজনৈতিক পালাবদলের কিছুকাল পরেই সম্ভবত! তবে সেই গল্পের অন্তর্নিহিত বক্তব্য এখনও যে সমানভাবেই সামাজিক একটা অসুখ তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। একইরকম সমকালীন। আজকের রাজনীতিতে বিশ্বাস, আদর্শ, জনস্বার্থ, এই শব্দগুলোর কোনও অর্থ নেই। এখন সবই যেনতেন প্রকারেণ।
চেয়ার দখল, ক্ষমতা হাতের মুঠোয় আনা, সেই ক্ষমতার উদ্ধত ব্যবহার, জনগণকে কোনও ভাবেই মানুষ না ভাবা, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে ক্ষমতা গ্রাস করাটাই রাজনীতি। সেখানে অন্য কোনও নিয়ম কিংবা নীতি, বোধ কিংবা বুদ্ধি, স্বাভাবিক সততা, আদর্শ, মানবিকতার কোনও জায়গাই নেই। নির্বিচারে চলছে মিথ্যাচার, ভণ্ডামি, শঠতা। এমনকী মানুষ মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যেও ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে রাজনীতির কুটিল রং। ক্ষমতার স্বার্থে পঙ্কিল করে দেওয়া হচ্ছে সুস্থ স্বাভাবিক প্রেমের সম্পর্কে। এবং সেটা এক সময় করেছিল এই রাজ্যের সবচাইতে প্রভাবশালী বামপন্থী দলটি। লেখকের কলম সেই আদর্শচ্যুত দলটির প্রতিই সরাসরি আঙ্গুল তুলেছিল। বেশ কিছু বছর পরে হলেও, বজবজের অঙ্গন নাট্য সংস্থা সমরেশ মজুমদারের সেই গল্পের এক বিশ্বাসযোগ্য নাট্যরূপ তুলে আনল ক’দিন আগে তপন থিয়েটারের মঞ্চে। নাট্যরূপ ও নির্দেশনা করেছেন সাত্যকি সরকার।
[আরও পড়ুন: দেশের নানা প্রান্তের ভাষাকে কুর্নিশ, এক বইয়ে ৩৬৫টি কবিতা লিপিবদ্ধ করলেন গুলজার]
এই অতিমারীর সময়েও তপন থিয়েটারে দর্শক সংখ্যা কম ছিল না। হলের মধ্যে বসেই রাসবিহারী মোড় থেকে কৃষক আন্দোলনের (Farmers Protest) সমর্থনে সমাবেশের স্লোগান শোনা যাচ্ছিল। বাইরে যে দল স্লোগান কানে আসছিল, ভিতরে সেই দলেরই চ্যুতি ও বিচ্যুতির পোস্টমর্টেম চলতে দেখে বেশ লাগছিল। নাটকের মূল চরিত্র মধ্যবয়স্ক এক নেতা অবনীমোহন। তার একমাত্র সন্তান সত্যপ্রিয় স্বেচ্ছায় নিজেকে অন্তরীণ করে রেখেছেন। দল তাঁর বিপ্লবী চিন্তাকে সরিয়ে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছে, সুতরাং সে তখন ‘প্রতি বিপ্লবী’। অবনীমোহন এখনও দলের সঙ্গে থেকেও আদর্শ, নীতি, সত্যকে আঁকড়ে থাকে। এর পাশাপাশি রয়েছে বাসব নামের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী বামদলের নেতাকে, যিনি ছাত্রনেতা থেকে এখন সাংসদ, ক্ষমতালোভী, স্বার্থান্বেষী, দুর্নীতিগ্রস্ত। বাজারি রাজনীতির প্রতিনিধি। অবনীমোহনের সঙ্গে বাসবের নীতিগত সংঘাত যেমন রয়েছে, তেমনই রাখা হয়েছে পুত্রবধূ ঝরনা ও কলেজ ছাত্রী নাতনি নন্দিনী এবং তাঁর শিক্ষক উজানের চরিত্রগুলো, যাঁরা নিঃশব্দে দাদু অবনীমোহনকে সমর্থন করে। প্রসেনিয়াম মঞ্চের ধাঁচেই নাট্য পরিকল্পনা, সরল ন্যারেটিভ। অনুপস্থিত সত্যপ্রিয় জানালার ফাঁক দিয়ে অফ ভয়েসে এসেছে, কখনও কবিতায়, কখনও গানে। ভাবনাটি ভাল। বিপ্লবকে এই মুহূর্তের বাংলা রাজনীতি থেকে আড়ালে রাখাই সঠিক। বিপ্লব এখন তো লোকচক্ষুর আড়ালেই!
পরিচালনার কৃতকৌশলে তেমন কোনও বাঁক নেই, বা তৈরি করা যায়নি কোন স্মরণীয় মুহূর্ত। যেটুকু হয়েছে, তার সবটাই সংলাপ নির্ভর। যেমন “আদর্শ সর্বস্ব রাজনৈতিক দল এখন সোনার পাথরবাটি”, “নিজেদের না পালটে সমাজের পরিবর্তন চাও”, “মৌনতায় পরিবর্তন হয় না” কিংবা “সত্য নীরব থাকলে মিথ্যার দাপট বাড়ে” ধরনের সংলাপ দর্শক হাততালি পেতে সাহায্য করেছে। কিন্তু ‘সংখ্যালঘু’ হৃদয় জয় করতে পারল কি? অভিনেতাদের কাজেও আন্তরিকতার অভাব। প্রায় সকলেই যন্ত্রের মত, প্রাণহীন রোবট। সংলাপের মাঝে অত ‘পজ’ নেওয়া কেন? তারই মধ্যে অবনীমোহনের ভূমিকায় অসীম ভট্টাচার্য কিঞ্চিৎ ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখেছেন। ছোট্ট দু’টি মুহূর্তে ঝরণা হিসেবে সুপর্ণা ভট্টাচার্য একটু নাটুকে হলেও পরিস্থিতিকে উতরে দেন। সাত্যকি সরকারের চরিত্রে বাসব আজকের জননেতার প্রটোটাইপ হতে গিয়ে খলনায়ক হয়ে গেছেন। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন প্রত্যুষা মণ্ডল (নন্দিনী), ঋজু ধারা (উজান), মৌসুমী সরকার(অপর্ণা), তাপস পাল(দেবেন) এবং প্রদীপ দাস(কল্যাণ)। মঞ্চ নির্মাণে, আলোর ব্যবহারে, বা আবহ রচনায় চোখে বা কানে লেগে রাখার কোনও দৃশ্য পাওয়া যায়নি। তবে বজবজের এই প্রায় অনামী দলটি একটা সময়োপযোগী নাট্য প্রযোজনা উপস্থিত করল সাহসের সঙ্গে – এটাই বড় প্রাপ্তি।