চারুবাক: চলমান বাস্তবকে এড়িয়ে, কিংবা গান, নাচের জাঁকজমক দিয়ে, প্রতীকী ভাবনা, পরাবাস্তব, জাদু বাস্তবের মোড়কে ও প্রযোজনার চাকচিক্যে কিছু বাংলা নাটক নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু সেখানে অনেক সময়েই বক্তব্য চাপা পড়ে যাচ্ছে চোখধাঁধানো বৈভবের আড়ালে। 'অনসম্বল' দলের নতুন প্রযোজনা 'ভীতি' সোহাগ সেনের নির্দেশনায় সেই মেকি আড়ালটি সরিয়ে সরাসরি আজকের বাস্তবে ঢুকে পড়েছে।
সোহাগ সেনের নাটকের উৎস ব্রেশটের 'ফিয়ার অ্যান্ড মিজারি অফ দি থার্ড রাইখ' হলেও বাংলা নাটকে তিনি শুধু বীজটুকু নিয়েছেন। আর সেই বীজকে এই দেশ ও রাজ্যের পটভূমিতে ফেলে এখনকার সময়ের একটি দলিল তৈরি করেছেন। যার মধ্যে তিনি খুব সাবলীল ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই নিয়ে এসেছেন আজকের তরুণ প্রজন্মের দিশাহীন আচরণ (অন্তু), বেপথু সন্তানের জন্য উচ্চমধ্যবিত্ত দম্পতির (রণ ও শর্মিষ্ঠা) অসহায়তা, একের অপরকে দোষারোপের ভঙ্গুর প্রয়াস। আবার অন্য দিকে রয়েছে এক নিঃসন্তান দম্পতির (দিব্য ও আফরিন) সমস্যা।
দিব্য উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, তাঁর খুব শিগগরিই বিদেশ সফরের এক সম্ভাবনা। কিন্তু সমাজকর্মী স্ত্রী আফরিনের কিছু সরকার বিরোধী কাজকর্ম হয়তো দিব্যর চাকরিতে অন্তরায় হয়ে উঠছে। জাতের দ্বন্দ্বকে এখানে ধর্মের দ্বন্দ্বে এনেছেন সোহাগ। আর অন্তুর চরিত্র যে বর্তমান দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির ছায়া সেটাও অস্পষ্ট নয়। খুবই সহজ ও সরল উপস্থাপনা। দুটি উচ্চবিত্ত পরিবার প্রায় প্রতিবেশীই বলা যায়। তাঁরা সান্ধ্য আড্ডায় নিজেদের ড্রয়িং রুমে বসে হালকা পানীয় নিয়ে সারাদিনের ধকল কাটাতে। কিন্তু ঘাড়ের ওপর এসে পড়া সমস্যাতো এড়ানো যায় না!
[আরও পড়ুন: রাজ্যের একাধিক নাট্যদলের অনুদান বন্ধ করল কেন্দ্র, ফের রাজনীতির শিকার বাংলার নাটক?]
মোটরবাইক হাঁকিয়ে অন্তুর বন্ধুরা রাতবিরেতে তাকে নিয়ে যায় বা দিয়ে যায় এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে। ছেলের এই বেপথু হওয়ার দায় নিয়ে রণ আর শর্মিষ্ঠার ঝগড়া চলে। ওদিকে দিব্যর চাকরির জায়গায় পরোক্ষে হেনস্তা হতে হয় আফরিনের কৃতকর্মের জন্য। দর্শক বুঝতেই পারেন এখনকার জীবনের এক টুকরো চলে এল তাদের সামনে। তবে হ্যাঁ, সোহাগ শুধু ছবিতেই মঞ্চে আনলেন, কিন্তু কোনও মন্তব্য করলেন না। করার প্রয়োজনই বা কী! দর্শক যে যার নিজের মতো সিদ্ধান্ত বা উপসংহার টানতেই পারেন। সেই জন্যই তো এমন ওপেন এন্ডেড প্রযোজনা। কৌশিক বোসের আবহ (বিশেষ করে বাইরে মোটরবাইকের কানফাটা আওয়াজ), বাবুল সরকারের আলো প্রযোজনার সারল্যকে অনুসরণ করেই কোনও বাড়তি ওজনদার করেনি নাটিকটিকে।
সোহাগ সেনের নির্মেদ নির্দেশনাও শিল্পীদের দিয়ে খুবই স্বাভাবিক ও নর্মাল অভিনয় আদায় করে নিয়েছে। প্রথম নাম দিব্যর চরিত্রে কৌশিক বোসের। চরিত্রটির অস্থিরপনা, ব্যক্তিত্ব, অসহায়তা সব মুহূর্তগুলোয় তিনি সাবলীল। পাশে দাঁড়িয়ে আফরিনরুপী সোমা মুখোপাধ্যায় তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করেছেন। সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের রণ আরও একটু সহজ স্বাভাবিক হতে পারত। কোথায় যেন একটু জড়তা ছিল। সুতপা ঘোষের শর্মিষ্ঠা তুলনায় স্বাভাবিক। রাগী ছটফটে অন্তুর স্বল্পক্ষণের উপস্থিরিটুকুই যথেষ্ট। 'ভীতি' আসলে আজকের আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের সামাজিক আতঙ্কেরই এক ছায়া ও প্রতিচ্ছায়া! আর এখানেই 'ভীতি' হয়ে ওঠে সময়ের প্রতিফলন।