বিশ্বদীপ দে: ২০০১ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘গদর: এক প্রেমকথা’ (Gadar: Ek Prem Katha)। ২২ বছর পরে মুক্তি পেয়েছে ছবির সিক্যুয়েল ‘গদর ২’ (Gadar 2)। মাঝের এই দু’দশকে পৃথিবী বদলে গিয়েছে আমূল। কিন্তু পরিচালক অনিল শর্মা বদলাননি। ছবির টিজার, ট্রেলার কিংবা গানের দৃশ্য দেখে আগেই অবশ্য একথা জেনে গিয়েছেন দর্শকরা। এরপরও যাঁরা হলে যাচ্ছেন, তাঁরা যে আসলে পুরনো এক পৃথিবীকেই দেখতে যাচ্ছেন তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। কিন্তু আদৌ কি নস্ট্যালজিয়ার ‘পুরনো চাল’ ভাতে বাড়ল? কেমন হল সানি দেওলের ‘কামব্যাক মুভি’?
২০২২ সালে অবশ্য সানির (Sunny Deol) একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ‘চুপ: রিভেঞ্জ অফ দ্য আর্টিস্ট’ নামের সেই ছবিতে সানির অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সানি দেওলের ভক্তদের আকাঙ্ক্ষা মেটেনি। তাই তাঁদের কাছে এটাই ‘গুরুর’ কামব্যাক। ৬৫ বছরের নায়কই যে ছবির প্রাণভোমরা তা বলাই বাহুল্য। এবং তিনি দর্শকদের প্রত্যাশা মিটিয়েছেন পুরোদমে। ২০০১ সালে বছর পঁয়তাল্লিশের সানি টিউবঅয়েল তুলেছিলেন। আর এবার কামানের চাকা থেকে অতিকায় হাতুড়ি, রিকশা মায় আস্ত ল্যাম্পপোস্ট তুলে ফেলেছেন তিনি। হাতুড়ির আঘাতে শত্রুর মুণ্ডচ্ছেদ করে গর্জে উঠেছেন। সবচেয়ে বড় কথা ক্লোজ আপে শটে বার্ধক্যের স্পষ্ট ছাপ সত্ত্বেও ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজকে পুরোদস্তুর বিশ্বাসযোগ্য করতে পেরেছেন।
[আরও পড়ুন: লজ্জার বোঝা কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে সত্যের নগ্নতা দেখাল অক্ষয়-পঙ্কজের ‘OMG 2’]
ছবির গল্প সকলেরই জানা। একাত্তরের ভারত-পাক যুদ্ধের ঠিক আগে পাকিস্তানে (Pakistan) বন্দি ছেলেকে উদ্ধার করতে পৌঁছেছেন অসহায় বাবা। এদিকে ‘দুশমন বহুত দুর্ধর্ষ’। মেজর জেনারেল হামিদ ইকবাল। নিষ্ঠুর সেই পাকিস্তানি সেনা অফিসারের লক্ষ্যই তারা সিংকে শিক্ষা দেওয়া। আগের বার জনা চল্লিশেক পাক সেনাকে একাই উড়িয়ে দিয়ে সেদেশের মেয়েকে নিজের দেশে নিয়ে গিয়েছে সে। এবার তার সরাসরি চ্যালেঞ্জ, ‘দেখতে হ্যায় আজ ইয়ে কেয়া উখারতা হ্যায়।’ তবে ট্রেলার দেখে যা মনে হয়, ছবির গল্প অবিকল সেরকম নয়। কিন্তু মূল আখ্যান এটাই। শেষ পর্যন্ত কী হবে তাও জানা। কিন্তু তাতে ৩ ঘণ্টা হলে বসে থাকতে অসুবিধা হবে না। শর্ত একটাই। আপনাকে সানির ভক্ত হতে হবে। তা না হলেও অন্তত গত শতকের নয়ের দশকের টিপিক্যাল বলিউডি অ্যাকশন ছবির অনুরাগী হতে হবে।
এই ছবির এক নায়ক যদি সানি হন, অন্য নায়ক দেশভক্তি। আবহে ‘বন্দেমাতরম’ বাজছে, আর সানি পাকিস্তানি সেনাদের আছাড় মারছেন এই দৃশ্যে হলের মধ্যে সিটি-হাততালির গমগমে আওয়াজ বুঝিয়ে দেয় অনিল শর্মা একেবারে সঠিক ভাবে দৃশ্যটি বুনতে পেরেছেন। পাশাপাশি ছবিকে সফল করতে বারবার ফিরে এসেছে প্রথম ছবিটির নানা দৃশ্য। উদ্দেশ্য, নস্ট্যালজিয়ার পারদকে চড়চড় করে বাড়িয়ে দেওয়া। ‘ম্যায় নিকলা গাড্ডি লেকে’, ‘উড় যা কালে কাওয়া’ গানগুলির পুনর্ব্যবহারও সেই কারণেই।
[আরও পড়ুন: সানি-প্রীতির বহর! আস্ত টিউবওয়েল হাতেই ‘গদর ২’ দেখতে হলে ভক্ত, ভাইরাল কীর্তি]
কিন্তু… তবুও ছবিতে খুঁত কিন্তু আগাগোড়া। গল্পের গরুর গাছে ওঠার প্রসঙ্গ অবশ্য বাদ দিতেই হবে। একেবারে নিপাট ‘মাস মুভি’তে ওসব ধরলে চলে না। পপকর্ন, ঠান্ডা পানীয় সহযোগে অন্ধকার হলে ছবি উপভোগে সেগুলো সচরাচর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কিন্তু এই বাইশ বছরে যে ‘এন্টারটেনমেন্টে’র রসায়নও বিস্তর বদলেছে! নায়ক, নায়কের ছেলে, তার প্রেমিকা-সহ গোটা পরিবারকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে ভিলেনের গরম গরম ডায়লগবাজি কিংবা কেবল চিত্রনাট্যের নির্দেশ রয়েছে বলেই চট করে সানির ছেলে জিতের (উৎকর্ষ শর্মা) প্রেমে পড়ে যাওয়া আজকের দিনে হজম করা মুশকিল। ছবির শুরুর দিক অকারণ দীর্ঘ। অথচ ছবির আসল ‘ইউএসপি’ বাবা-ছেলের সম্পর্কই সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তবে সেজন্য সানি নন, দায়ী অনিল শর্মার ছেলে উৎকর্ষই। ছবির সবচেয়ে দুর্বলতা তিনি এবং আমিশা প্যাটেল। দু’জনেই পাল্লা দিয়ে খারাপ অভিনয় করেছেন। অ্যাকশন দৃশ্যে তবু অনিল-পুত্র মানানসই। কিন্তু নাচগান কিংবা রোম্যান্স অথবা মা-বাবার সঙ্গে আবেগপূর্ণ দৃশ্যে একেবারেই বেমানান উৎকর্ষ। অথচ তাঁকে ‘লঞ্চ’ করতেই নাকি ‘গদরে’র পরিকল্পনা করেছিলেন পরিচালক! আমিশার অতি অভিনয়ও বিরক্তিকর। সানির সঙ্গে যাঁর টক্কর সেই মণীশ ওয়াধা মন্দ করেননি। কিন্তু কোনও কোনও দৃশ্যে তাঁর অভিনয়ও চড়া সুরে বাঁধা। যা এমন এক ছবির ক্ষেত্রেও চোখে লাগে। তবে সিমরত কউরের মিষ্টি উপস্থিতি ভালই লাগে।
কিন্তু এই সব খুঁত ঢেকে দিয়েছেন একা সানি। ছবি জুড়ে কেবল তাঁকে দেখলেই মনে হয় যেন থমকে গিয়েছে সময়। শরীরে বার্ধক্য টোকা দিলেও পারফরম্যান্সে তা প্রভাব ফেলেনি। এত বড় ছবিটা যে বসে দেখা যায়, তা স্রেফ তাঁর জন্যই। তাঁর ভক্তদের কাছে তাই ‘গদর ২’ একেবারে ‘পয়সা উশুল’ ছবি। বছরের গোড়াতেই মুক্তি পেয়েছিল ‘পাঠান’। শাহরুখ খানের দুরন্ত কামব্যাক নজির গড়েছিল। সামনের মাসে ‘জওয়ানে’র প্রতীক্ষাও শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার আগে পর্দায় সানির প্রত্যাবর্তনওততটা রাজকীয় না হলেও চমকপ্রদ হল, একথা বলাই যায় নিঃসন্দেহে। গতকাল মুক্তি পেয়েছে রজনীকান্তের ‘জেলার’। ৭২ বছরের এক সুপারস্টারের সোয়্যাগে চমকে গিয়েছেন অনুরাগীরা। শাহরুখ-রজনীর মতো স্টারডম হয়তো নেই সানির। কিন্তু তাঁর ‘আড়াই কেজির’ হাতের জাদু এখনও ফুরিয়ে যায়নি। একা একটা ছবি টেনে নিয়ে যেতে তিনিও যে কম যান না, তা বুঝিয়ে দিলেন তিনি।
ছবির শেষে জানা যায়, এটাই শেষ নয়। এরপর আসবে ‘গদর’ সিরিজের তৃতীয় ছবি। পরিচালকের ভরসা যে সানির উপরে কতটা, তা এই সিদ্ধান্ত থেকেই বুঝে নেওয়া যায়। সেই ভরসা যে অকারণ নয়, তার প্রমাণ রয়েছে ‘গদর ২’র ছত্রে ছত্রে।