shono
Advertisement

পুরনো বন্ধুত্বের স্পর্শ, অতিরিক্ত মার্কিন নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার পাশেই ভারত

স্বাক্ষরিত হল রাশিয়ার সঙ্গে নব্য চুক্তি। দেশের পররাষ্ট্র-নীতিতে এটি বড় বাঁক।
Posted: 10:47 AM Dec 13, 2021Updated: 04:35 PM Dec 13, 2021

অতিরিক্ত ওয়াশিংটন নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এল ভারত। স্বাক্ষরিত হল রাশিয়ার সঙ্গে নব্য চুক্তি। দেশের পররাষ্ট্র-নীতিতে এটি বড় বাঁক। ভ্লাদিমির পুতিনদের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক বহু প্রাচীন। অমলিন বন্ধুত্বের পথে এই দু’টি দেশ এগিয়ে গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের আগ্রাসী মনোভাবকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জানানো যাবে বইকি। বন্ধুত্বের এই সরণিতে ইরানকে পেলে আরও ভাল। লিখছেন সব্যসাচী বিশ্বাস 

 

Advertisement

‘ওমিক্রন’ নামক করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রাদুর্ভাব, ভারতের প্রথম ‘চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ’ বিপিন রাওয়াতের অপঘাতে মৃত্যুর মতো আলোড়ন সৃষ্টিকারী খবরের পাশাপাশি যে হেডলাইন গত একসপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তা হল ইউক্রেন সংকট।

মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা স্পষ্ট ছবি দিয়ে দেখিয়েছে, ইউক্রেন-রুশ সীমান্তে মস্কো লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন রেখেছে। হঠাৎ করে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া যে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, এমন আশঙ্কায় ইউরোপ থরথর। সামনাসামনি নয়, রুশ রাষ্ট্রনায়ক ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভিডিও মারফত শীর্ষবৈঠক সারতে হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। রুশ প্রেসিডেন্টের মতিগতি বুঝতে যখন দুনিয়া তোলপাড়, হোয়াইট হাউসকে শলাপরামর্শ করতে হচ্ছে জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মর্কেল থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে, ঠিক সেই সময় পুতিন যদি কোনও দেশকে ‘পুরনো বন্ধু’ বলে উল্লেখ করে বিশেষ চুক্তি সই করেন, তা হলে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ার জন্য শ্লাঘা বোধ করা যেতেই পারে। আপাতত সেই গর্বে গর্বিত নয়াদিল্লি। ভারত-রাশিয়ার মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর যদি নয়াদিল্লির গত এক দশক ধরে চলতে থাকা পররাষ্ট্র-নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হয়, তা হলে সেটা কিন্তু ঘটছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে।

[আরও পড়ুন: প্রতিরক্ষায় স্বনির্ভরতা কি অধরা, সেনা সর্বাধিনায়কের পরিণতিতে উঠছে প্রশ্ন]

এর অর্থ, ভারত যেমন সাম্প্রতিকের অতিরিক্ত ওয়াশিংটন নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে উদ্যোগী, তেমনই রাশিয়ারও এখন আমেরিকার সঙ্গে দড়ি টানাটানিতে বন্ধু দরকার। শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী বন্ধু। ‘পুরনো বন্ধু’। সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ৬৪ খোপের দাবার বোর্ডে আচমকাই বেজিং ও মস্কোর মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। ইউক্রেন প্রশ্নে চিন আর রাশিয়া যে এক সারিতে দাঁড়িয়ে নেই, তা বেজিং পরিষ্কার করে দেওয়ার পর, ভারতের সামনে সুবর্ণ সুযোগ মস্কোর সঙ্গে বন্ধুত্ব ঝালিয়ে নেওয়ার।

ভারতের সামনে কেন সুবর্ণ সুযোগ? কারণ, এই বছরে আফগানিস্তানে আমেরিকার পররাষ্ট্র-নীতি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ার সময় পর্যন্ত মনে করা হচ্ছিল, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিন এবং রাশিয়া বুঝি একই রেখায় অবস্থান করছে। সেজন্যই তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্করক্ষা হোক কিংবা প্যালেস্তাইনের পাশে থাকা, সবক্ষেত্রেই মস্কো এবং বেজিং অনেকটা এক সুরে কথা বলছিল। আর, নয়াদিল্লি ছিল বিপরীত অক্ষে, ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকে। গত বছর পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, গালওয়ানের সংঘর্ষের পর ভারতের রীতিমতো চিন্তা হয়ে গিয়েছিল যে, চিনের সঙ্গে এই স্নায়ুযুদ্ধ চলতে থাকলে, রাশিয়া সমরাস্ত্র সরবরাহ করবে তো? পরিস্থিতি সামলাতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে মস্কো ছুটতে হয়েছিল। সেই সফরেই দু’-দেশের সম্পর্কের শৈত্য কমে।

ভ্লাদিমির পুতিন ও নরেন্দ্র মোদির চুক্তি-সই এবং রুশ প্রেসিডেন্টের ভারতকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া যদি নয়াদিল্লির পুরনো অক্ষে ফেরার জোরাল ইঙ্গিত হয়, তা হলে মনে রাখা উচিত, এই অক্ষে আরও একটি দেশ সর্বদাই থাকতে পারে। ইরান। নয়াদিল্লির সঙ্গে তেহরানের সুসম্পর্ক সবসময়ই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকতে পারে, কারণ শিয়া প্রভাবিত ইরান প্রতিবেশী আফগানিস্তানে সুন্নি কট্টরপন্থী তালিবানদের ক্ষমতায় আসা নিয়ে চিন্তায়, ইসলামাবাদকেও তেমন বিশ্বাস করে না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারত, রাশিয়া এবং ইরান স্বাভাবিক মিত্রের পুরনো ছন্দে ফিরে যেতে পারে। আর, তাতে চিন এবং পাকিস্তানের যুগলবন্দির প্রতিস্পর্ধী অক্ষও যথেষ্ট জোরাল থাকবে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শংকরও এই জোটের সম্ভাবনা জেনেই গত কয়েক মাসে বারেবারে তেহরান গিয়েছেন, ইরানের নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোয় অনেক সময় বিনিয়োগ করেছেন। ইরানের ক্ষেত্রে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে একবগ্গা নীতি ছিল, এবং তার জন্য আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার চাপে নয়াদিল্লিও তেহরানের সঙ্গে দূরত্বরক্ষা করে চলত। এখন থেকে পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। জো বাইডেন যেহেতু বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাই তিনি জানেন সেই সময় সই হওয়া ইরানের সঙ্গে চুক্তি আসলে এশিয়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করতে তা কত কার্যকর হতে পারে। তাই জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে বসার পর তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন তেহরানের সঙ্গে ফের সমঝোতায় যেতে।

অন্যদিকে ইরানও বারেবারে বোঝাচ্ছে যে, আমেরিকায় শাসক বদলের পরে আবার আলোচনা দরজা খুলতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াতে গিয়ে নয়াদিল্লি তেহরানের সঙ্গে যে দূরত্ব বাড়িয়েছিল, সেটাও সংশোধন করে নেওয়ার সময়।

ভারতের সামনে যদি রাশিয়া এবং ইরানের সঙ্গে হৃত সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের সেরা সুযোগ থাকে, তা হলে বোঝা দরকার, চিনও কেন আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে এত আগ্রহী? কারণ, চিন আমেরিকার বাজার দখলের সুযোগ ছাড়তে চায় না। বাইডেনের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বহু আলোচিত সেই শীর্ষ বৈঠকের পর থেকেই চিন বুঝে গিয়েছে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ যতই থাকুক, চিনা জিনিস দিয়ে আমেরিকার বাজার ছেয়ে রাখতে গেলে সব বিষয়ে অহি-নকুল সম্পর্ক রাখা যাবে না। তাই ইউরোপের রাজনীতিতে যেভাবে পুতিন আমেরিকা এবং ন্যাটো-ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে দড়ি টানাটানির খেলা খেলছেন, সেখানে বেজিং দুই পক্ষের সঙ্গে সমদূরত্বের নীতি নিয়ে চলতে চায়।

এই পরিস্থিতি ভারতের সামনে যদি সুযোগ এনে দিয়ে থাকে, তা হলে পুতিনের মন বোঝার উপায় কী? চুক্তি সই তো বটেই, সেই সঙ্গে রুশ সংবাদপত্রে বা সাময়িকীতে রুশ প্রেসিডেন্টের লেখা মন দিয়ে পড়া। পুরনো বামপন্থী অভ্যাস বলে, স্বকীয় রাজনৈতিক অবস্থান বোঝাতে তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখো। সেটা শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বাল ঠাকরের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, তেমনই পুতিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

[আরও পড়ুন: বিতর্ক ছাপিয়ে ‘এভারেস্টের চূড়া’য় পৌঁছেছিলেন রাওয়াত]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement