লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
'কুরসির কিসসা' কোনও নির্দিষ্ট সড়ক ধরে এগোয়নি। সময়রেখায় আগু-পিছু করেই আমরা কথা বলেছি দেশের কুরসি ও তাকে ঘিরে থাকা নানা ইতিহাস-গুঞ্জন-মিথ নিয়ে। এবারের লেখায় তাহলে পৌঁছনো যেতেই পারে একেবারে প্রথম লোকসভা নির্বাচনে। এবারের ভোট যেখানে ৭ দফায়, সেখানে দেশের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ছিল ৬৮ দফা! দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যে নির্বাচনের আগে স্লোগান দিয়েছিলেন. ''নয়া হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ।'' যে ভোটের সাফল্যের পিছনে ছিলেন তৎকালীন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন। তাঁর মতে, এটাই ছিল 'মানব ইতিহাসে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এক্সপেরিমেন্ট'।
কিন্তু কেন? কেন ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি- প্রায় চার মাস ধরে হয়েছিল ভোট! যা সারা পৃথিবীর নিরিখেই একটা 'রেকর্ড'। এবার আসা যাক সেপ্রসঙ্গেই। আসলে সে এক ভিন্ন সময়। ভিন্ন পৃথিবী বললেও কি অত্যুক্তি হবে? দেশ তখন সবে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। সব কিছুই যেন নতুন, আনকোরা! এহেন পরিস্থিতিতে প্রথম লোকসভা নির্বাচন ছিল এক বিরাট, বিপুল চ্যালেঞ্জের। সাধারণ নাগরিকদের কথা বাদই দিন, যাঁরা ভোট করাবেন তাঁরাও ছিলেন অন্ধকারে। সরকারি কর্মচারীরা ঠিকভাবে জানতেনই না, ভোট কীভাবে নেওয়া হবে। যা সফল করে তুলতে কর্মী-অফিসারদের প্রশিক্ষণ যেমন দেওয়া হতে থাকে পাশাপাশি ভোটদান নিয়েও বোঝানো হতে থাকে সকলকে। আর এই পুরো ব্যাপারটির নেপথ্যে যিনি ছিলেন, তিনি সুকুমার সেন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার। ১৯৫০ সালের ২৫ জানুয়ারি গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন। যার নেতৃত্বে ছিলেন আইসিএস আধিকারিক সুকুমার সেন। মার্চে তাঁর নিযুক্তির অব্যবহিত পরই জওহরলাল নেহরু ঘোষণা করেন সেবছরই হবে ভোট। শেষপর্যন্ত অবশ্য তা হয়নি। কিন্তু নেহরুর ঘোষণার পর থেকেই বোঝা গিয়েছিল, চ্যালেঞ্জটা কত বড়। আগেই বলেছি, সাধারণ মানুষ তো বটেই খোদ প্রশাসনের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না ভোট সম্পর্কে!
[আরও পড়ুন: পোর্শেকাণ্ডের মধ্যেই ফের মহারাষ্ট্রে যুবকের গাড়ি পিষল ৭ জনকে! সংকটজনক তিন মাসের শিশু]
সুকুমারবাবু একেবারে দোরে দোরে ঘুরে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেইমতো দেশজুড়ে, গাঁ-গঞ্জ প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়ে শুরু হল ভোটার তালিকা তৈরির কাজ। সে এক কর্মযজ্ঞ। এখানে একটা আশ্চর্য পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের ২৮ লক্ষ মহিলার নাম ভোটার তালিকায় তোলা যায়নি। কারণ? তাঁরা কেউ নিজেদের যথাযথ নামই বলে উঠতে পারেননি! তবে শেষপর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর বাদে দেশের বাকি অংশের ১৭৩.২ মিলিয়ন ভোটারের নাম নথিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। যার ৪৫ শতাংশই মহিলা।
এদিকে দেশের শিক্ষিতের হারের কথা মাথায় রেখে ভাবনাচিন্তাও করতে হচ্ছিল। যেদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের অক্ষরের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ ঘটেনি, তাঁরা কী করবেন? আর এখান থেকেই দলপিছু প্রতীকের পরিকল্পনা। যেমন কংগ্রেস নিল জোড়া বলদ ('হাত'-এ পৌঁছতে তখনও অনেক দেরি)। সবশুদ্ধ স্টিলের ব্যালট বাক্স তৈরি করা হল ১৯ লক্ষ। প্রথমে ঠিক হয়েছিল প্রতিটি প্রার্থীর জন্য আলাদা রঙের বাক্স থাকবে। কিন্তু পরে পরিকল্পনা বদলে যায়। ঠিক হয় প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য আলাদা ব্যালট বাক্স রাখা থাকবে। পুরো বিষয়টাই থাকবে গোপনে। সেখানে গিয়ে ভোটার তাঁর পছন্দের প্রার্থীর হয়ে তাঁর ভোটটি দেবেন। এদিকে ব্যালট পেপার ছাপা হল ৬২ কোটি। সাইজ তৎকালীন এক টাকার নোটের সমান। এই পরিসংখ্যান থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, কতটা বিপুল খরচ হয়েছিল প্রথমবার ভোট সম্পন্ন করতে গিয়ে। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা! সেযুগের হিসেবে এটা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা অঙ্ক।
[আরও পড়ুন: থেকেছেন মোদি, বছর ঘুরলেও বাকি ৮০ লাখের বিল! আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি হোটেলের]
আর একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল পরিবহণ। ভোটকর্মীদের সংখ্যা যেহেতু সীমিত, তাই তাঁদেরই একাধিক কেন্দ্রের ভোট সামলাতে হয়েছে বিভিন্ন দফায়। এক দফায় শেষ হলেই ছুটতে হত অন্যত্র। সেযুগে গাড়িঘোড়ার সংখ্যাও বিরাট ছিল না। তাই এমনকী, ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠেও কর্মীরা এক কেন্দ্র থেকে অন্যত্র যেতেন। সেই কারণেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে এতগুলি দফা ও এতটা সময় ব্যয় হয়েছিল। সব মিলিয়ে চার মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল। কিন্তু সেবারের অভিজ্ঞতা দারুণ ভাবে কাজে এসেছিল নেহরু প্রশাসনের। 'গণতন্ত্রের উৎসব' আয়োজন করতে নেমে শুরুতেই এই সাফল্য হয়ে রয়েছে ইতিহাসের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। অবশেষে ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর শুরু হল নির্বাচন। তবে ভোট শুরু হয়ে যাওয়ার পরও কিন্তু কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কেননা পুরো বিষয়টা এতটাই নতুন, একে বাস্তবায়িত করাটাই ছিল চ্যালেঞ্জ।
দেশ তখন কংগ্রেসময়। ৪৮৯টি আসনের মধ্যে ৩৬৪টি আসনেই তাই কংগ্রেসের জয় কোনও অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না। একদিকে নেহরু, অন্যদিকে ভারতীয় জনসঙ্ঘের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো তারকা প্রার্থীরা পেয়েছিলেন অনায়াস জয়। অথচ মোরারজি দেশাইয়ের মতো নেতাকে বম্বে (আজকের মুম্বই) কেন্দ্রে হারতে হয়েছিল। এমনকী, সেবারের ভোটে হারতে হয়েছিল খোদ বি আর আম্বেদকরকেও! তিনি হেরেছিলেন নিজেরই একদা ব্যক্তিগত সহকারী নারায়ণ সাবোদা কাজরোলকরের কাছে। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ ফলাফল ছিল রবিনারায়ণ রেড্ডির। এই কমিউনিস্ট প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান ছিল নেহরুর থেকেও বেশি! তবে আসলে সবচেয়ে চমকপ্রদ বোধহয় সেবার ছিল পুরো নির্বাচনটাই। এত বড় দেশে এমন একটা ব্যাপার যে ঘটানো যায়, সেদিন গোটা বিশ্বকে তা দেখিয়েছিল ভারত। সেই সাফল্যের রোশনাইয়ের কাছে আর সবই বুঝি ফিকে।