কিংশুক প্রামাণিক: দিদি কখন আসবেন? পরিষ্কার ‘বাংলা’ শুনে ঘুরে দাড়ালাম। সে কী, নাগাবাবা এমন সুন্দর বাংলা বলতে পারেন? বাংলা কেন, ইংরেজি, পাঞ্জাবি, হিন্দি, গুজরাটিও আমি বলতে পারি। অবাক হইনি। ঠিকই তো বলছেন। নাগা সন্ন্যাসী বলে কথা। এদেশ-সেদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। পাঁচ-সাতটা ভাষা জানতেই পারেন। আমার ধারণা ছিল নাগা সন্ন্যাসীরা বদমেজাজি। রেগে গেলে ত্রিশূল নিয়ে তেড়ে আসেন। তবে এই নগ্ন বৃদ্ধের সঙ্গে খানিক মিশে, তাঁর কথা শুনে আমি পুলকিত। তাঁর কাছে এমন এক হারানো ইতিহাসের গল্প শুনলাম। বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি।
কপিলমুনির মন্দিরের বাঁদিকে রাস্তার দু’পাশে আখড়া। নাগা সাধুরা (Naga sanyasi) বলেন, নাকেঘাটে বা কুঠিয়া। ঊর্ধ্বমুখী ধুনির সামনে বসে থাকেন নাগা সন্ন্যাসীরা। ধ্যানমগ্ন। ভিতরে একটি ঘর আছে। সেখানে থাকার মতো ব্যবস্থা। আছে টেলিভিশনও। নাগাবাবারাও এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। ব্লু-টুথে কথা বলেন। ২৮ ডিসেম্বর বিকেল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) একটু পরেই আশ্রমে আসবেন। হাতে সময় আছে। দাঁড়ালাম একটি কুঠিয়ার সামনে। লেখা রয়েছে, মোহন্ত নাগাবাবা মঙ্গলগিরি। সন্ন্যাসী একদৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে। আমায় ভ্রুক্ষেপ করছিলেন না। কথা বলব কি বলব না ভাবতে খানিক সংকোচ বোধ করছিলাম। তখনই বাংলায় কথা।
আমি বললাম, আপনি এত ভাল বাংলা বলেন?
শ্বেতচন্দনে আবৃত বাবু হয়ে অবিরত বসে থাকা নগ্ন দেহে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল। তিনি আমার মুখের দিকে চাইলেন।
–জানি তো। আমি তো বাংলারই লোক।
–মানে আপনি বাঙালি?
–বাংলার লোক হতে গেলে কি বাঙালি হতে হয়?
–তা না, আসলে…
–আমি হরিয়ানার লোক। ছোট থেকে বাংলায় আছি।
–ছোট থেকে মানে? কবে থেকে আপনার এই রূপ?
–উফফ, তুমি বহুত প্রশ্ন করছ! যাও।
মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সাধু। চুপ করে গেলাম। পরক্ষণে মনে খবরের খিদেটা উঁকি দিয়েছে। উনি আর পাঁচজন নাগাবাবার মতো নন। রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। সাহস করে আবার এগিয়ে গেলাম কাছে। তারপর শুনলাম যে কথা, তা সাজিয়ে দিচ্ছি গল্পের আকারে।
[আরও পড়ুন: জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও ভয়ংকর! কেন ইতিহাসে অবহেলিত মানগড়ের গণহত্যা]
১৯৭০ সালের শেষ ভাগ। অলোক চন্দ্রা নামে ১৯ বছরের ছেলেটি সিটি কমার্স কলেজে পড়ে। বরানগরে কুঠিঘাটে মামার বাড়িতে থাকা। বাবা ভারতীয় সেনা বাহিনীতে। মা হরিয়ানায়। তখন নকশাল আন্দোলনে উত্তাল বাংলা। কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে দিনবদলের গান। একদিন দ্বারভাঙা হলের সামনে এক সহপাঠী আলাপ করিয়ে দিলেন চারু মজুমদারের সঙ্গে। পরে আলাপ জঙ্গল সাঁওতাল, কানু সান্যালের সঙ্গেও। আন্দোলনে গা ভাসালেন তরুণ। দুধে আইপিএস রুণু গুহনিয়োগীর উপর রাগ এখনও যায়নি। সবাই একে একে ধরা পড়ছে। অকথ্য অত্যাচার। একদিন খবর এল তাঁকেও হন্যে হয়ে খোঁজা হচ্ছে। পালালেন অলোক। হাওড়া স্টেশনে এসে দিল্লির ট্রেন। তারপর এদিন-সেদিক ঘুরে গুজরাট। আরও বহু দেশ বিদেশ। তিনি বলেন, “ধরা দিতে চাইনি। জানতাম, লালবাজারে নিয়ে গিয়ে আমায় পিটিয়ে খুন করা হবে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে কুম্ভমেলায় এক সাধুবাবার সঙ্গে দেখা। তিনি নাগা সন্ন্যাসী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর কাছে থেকে বদলে গেল মন। ভুলগুলো কোথায় স্পষ্ট বুঝতে শুরু করলাম। মানুষের মুক্তি কোথায়, নতুন করে খুঁজে পেলাম।”
নকশাল আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া নাস্তিক তরুণ হয়ে গেলেন সন্ন্যাসী। নাম হল নাগাবাবা মঙ্গলগিরি। বাংলার বামফ্রন্ট সরকার আসার পর তিনি প্রকাশ্যে আসেন। ’৮০ সালে নাগা বেশ। ২০১০ সালে নাগা সাধুদের সঙ্গে প্রথম এলেন গঙ্গাসাগর মেলায়। যে কলকাতা থেকে পালিয়েছিলেন, চল্লিশ বছর পর সেখানে এলেন সাধুর বেশে। শেষে সাগর। আর ফিরে যাওয়া হয়নি। বললাম, এত কথা মনে রেখে এতদিন আপনি পাথর হয়ে বসেছিলেন? জবাব দিলেন, “জানো, মকরস্নান হয়ে গেলে সব নাগা সাধু চলে যান। আমি কিন্তু যাই না। একাই থাকি। এই বাংলা ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছা করে না। আমি ভোর তিনটেয় উঠি। তার পর সাগরে স্নান করে মন্দিরে প্রণাম করে তপস্যায় বসি। সাধারণ মানুষের মতোই ভাত রুটি খাই। রাজ্য-দেশ-বিদেশ, আমি সব খবর রাখি। টিভি দেখি, কাগজ পড়ি। এখানেই মরতে চাই। নিজের ভাণ্ডারা নিজেই দেব।”
[আরও পড়ুন: হাজার খুঁজেও মেলেনি সরকারি চাকুরে পাত্র, ‘অবসাদে’ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী যুবতী]
বললাম, আমার একটা কৌতূহল নিবৃত্ত করুন। এই যে নগ্ন হয়ে থাকেন আপনারা, কামোন্মাদোনা শূন্য হয়ে যায়? তিনি বলেন, “ভুল, যিনি একথা বলেন, ভুল বলেন। দিনের শেষে আমিও রক্তমাংসের মানুষ। আমার কাম জাগে। কিন্তু তাকে নিবৃত্ত করতে শিখতে হয়। সেটাই তপস্যা।” খানিক চুপ রইলাম। যুগ-যুগান্তর ধরে মকরস্নান ঘিরে কত ঘটনা, কত ইতিহাস। এক যুগ পরে হারানো ছেলে খুঁজে পাওয়ার উপাখ্যান। কিন্তু এক নকশাল নেতার নাগা সন্ন্যাসী হওয়া বোধহয় সাগরপাড়ে নতুন মহাকাব্য। সূর্য ওঠে সাগরে (Gangasagar)। নতুন বছরের প্রাতে সেদিকে তাকিয়ে মোহন্ত নাগাবাবা মঙ্গলগিরি আজও ভাবেন, সত্তরের সেই দিনগুলিতে সত্যিই কী কী ভুল ছিল।