সব্যসাচী বাগচী: শচীন তেণ্ডুলকরের (Sachin Tendulkar) ঘরের মাঠ ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম। নাকি সেই ২০০৯ সালে প্রথমবার নেমেই শতরান করা ইডেন গার্ডেন্সে (Eden Gardens) ! বিরাট কোহলির (Virat Kohli) কাছে একদিনের ক্রিকেটে ৪৯তম শতরান করার সেরা মঞ্চ কোনটা? সেটা নিয়ে তর্ক চলুক। চলতে থাকুক। তবে নিজের ৩৫তম জন্মদিনে দক্ষিণ আফ্রিকার (South Africa) বোলারদের পিটিয়ে বিরাট যে শৃঙ্গ অর্জন করলেন, এর কি আদৌ কোনও তুলনা করা চলে? চলে না। কারণ বিরাট যে চলতি বিশ্বকাপেই (ICC ODI World Cup 2023) তাঁর ‘আইকন’-কে ‘গড অফ ক্রিকেট’-কে ছুঁয়ে ফেললেন। তাই তাঁর মাইলস্টোন গড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ইডেনের ৭০ হাজারের গ্যালারিতে ভেসে উঠল। সেলিব্রেশনও ছিল দেখার মতো। একেবারেই বিরাটসুলভ নয়।
গত ২ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধেও খুনে মেজাজে ব্যাট করেছিলেন। কিন্তু কাঙ্খিত মাইলস্টোন অধরা ছিল। আসমুদ্র হিমাচলের ঘটেছিল স্বপ্নভঙ্গ! ৯৪ বলে ৮৮ রানে ফিরেছিলেন ‘কিং কোহলি’। তবে এদিন আর কোনও ব্যাগেজ রাখলেন না। ৪৯তম শতরানের ইনিংসে ১২১ বলে ১০১ বলে অপরাজিত রইলেন। এই মহাকাব্যিক ইনিংস ১০টি চার দিয়ে সাজানো ছিল। তবে এই মেগা মাইলস্টোন গড়ার আগে অবশ্য বিশ্বকাপে সর্বাধিক রান স্কোরারদের তালিকায় শচীন ও রিকি পন্টিংয়ের পরেই নাম লিখিয়ে ফেলেছিলেন। কাপ যুদ্ধের ৪৫ ম্যাচে মাস্টারব্লাস্টার করেছিলেন ২২৭৮ রান। দুইয়ে থাকা পন্টিংয়ের ব্যাট থেকে এসেছিল ৪৬ ম্যাচে ১৭৪৩ রান। তৃতীয় স্থানে ৩৪ ম্যাচে বিরাট সেরে নিলেন এই নজির।
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৪৯তম শতরানের খুব কাছেই ছিলেন বিরাট। তাও আবার শচীনের সামনেই। সেই ম্যাচ দেখার জন্য সপরিবারে ভিভিআইপি বক্সে উপস্থিত ছিলেন ‘আধুনিক ক্রিকেটের ডন।’ তাঁর সামনেই মাইলস্টোন শতরান করে নিজের উপস্থিতি ফের একবার বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ‘কিং কোহলি।’ কিন্তু সেটা আর হল কোথায়! যদিও এবার সব সুদে-আসলে তুলে নিলেন মহাতারকা। ১৪ বছর পর ফের ইডেনে তাঁর ব্যাট থেকে এল তিন অংকের রান। সেই সময় তরুণ বিরাট শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১১৪ বলে ১০৭ রান করেছিলেন। ৯৩.৮৫ স্ট্রাইক রেট বজায় রেখে সেই ইনিংসে মেরেছিলেন ১১টি চার ও ১টি ছক্কা। এদিন বিরাট নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। একইসঙ্গে আরও একটি রেকর্ড গড়ে শচীনের পরেই নাম লেখালেন তিনি। ৫০ ওভারের ফরম্যাটে শচীনের পর ভারতের দ্বিতীয় ব্যাটার হিসাবে প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে করলেন ৩০০০ রান।
[আরও পড়ুন: বিরাটের ৩৫তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে ইডেনে এবি ডিভিলিয়ার্স, দেখুন ভাইরাল ভিডিও]
২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শেষ টেস্ট। ওয়াংখেড়ে থেকে চোখের জলে বিদায় নিয়েছিলেন ‘গড অফ ক্রিকেট’। এর দুই বছর আগের রাতটা মনে করে দেখুন। ২০১১ সালের ২ এপ্রিলের রাত। শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপের ফাইনালে হারিয়ে এই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের মাঠে ঘুরেছিলেন ‘মাস্টার ব্লাস্টার’। সেই রাতে বিশ্ব জয়ের পর শচীনকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বিরাট। অনেকেই তাই তাঁর ৪৯তম শতরানের সেরা মঞ্চ বলে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামকেই ধরে নিয়েছিল। তবে আসমুদ্র হিমাচলকে চুপ করিয়ে শতরান থেকে ১২ রান দূরে বিরাট ফিরে যান। যদিও এবার আর তাঁকে থামানো গেল না। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হোম গ্রাউন্ডে জন্মদিনে গড়লেন বিশেষ মাইলস্টোন।
তিন দিন আগে ৪৯তম শতরান না করতে পারলেও, বিরাট তাঁর ‘আইকন’-কে ছাপিয়ে অন্য একটি রেকর্ড নিজের নামে করেছিলেন। শচীন তাঁর দীর্ঘ ২৪ বছরের কেরিয়ারে কোনও এক বছরে মোট ৭বার ১০০০ রান করেছিলেন। ১৯৯৪, ১৯৯৬, ১৯৯৭, ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৩ ও ২০০৭ সালে এই কীর্তি গড়েছিলেন। বিরাট এবার সেই রেকর্ডেও নিজের নাম লিখিয়ে নেন। এই নিয়ে আটবার কোনও এক বছরে ৮বার ১০০০ রান করার নজির গড়েছিলেন তিনি। ২০১১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে এই কীর্তি গড়ে শচীনকে টপকে যান বিরাট।
সুনীল গাভাসকরের সময় ক্রিকেট কোচেরা বলতেন তাঁর খেলা দেখে শিখতে। শচীনের যুগে তাঁরা বলতেন মুম্বইকরের খেলা উপভোগ করতে। এখন কোচেরা বলেন বিরাটের খেলা দেখ আর শুধু হাততালি দাও, কারণ অন্য গ্রহের মানুষের খেলা কখনও অনুকরণ করা সম্ভব নয়। তবে কি বিরাটই ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার? কারণ এবার যে তিনি একদিনের ক্রিকেটে ‘মাস্টার ব্লাস্টার’-এর ৪৯তম শতরানে ভাগ বসিয়ে নিলেন। গত ম্যাচের তুলনায় এবার প্রতিপক্ষ এবং পিচ ছিল আরও কঠিন। তবুও বিরাট সদর্পে গড়লেন মাইলস্টোন। ফলে শুধু সংখ্যার বিচারে বিরাটকেই কি সর্বকালের সেরা ব্যাটার বলে দেওয়া যায়? ফের একবার এই বিতর্ক কিন্তু বিরাটই জিইয়ে রাখলেন।