বিশ্বদীপ দে: একটা টুইট। আর তার ধাক্কায় সময়ের শরীর থেকে যেন খসে পড়ল ন’টা বছর। ফিরে এল ধাতব শীতল কণ্ঠস্বরের একটা প্রশ্ন, ”কার নাম মালালা (Malala Yousfzai)?” ২০১২ সালে স্কুলছাত্রী মালালাকে গুলি করেছিল এহসান নামের এক তালিবান জঙ্গি। সেই জঙ্গি, জেল পলাতক এহসান ফের হুমকি দিয়েছে টুইটারে। জানিয়ে দিয়েছে, আবার সুযোগ পেলে আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না সে। আপাতত সেই খবরেই ফের তোলপাড় পৃথিবী। পাশাপাশি আবারও ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ফিরে আসছে পুরনো সময়। মালালা এখন নোবেলজয়ী তরুণী। তাঁর জীবন বদলে গিয়েছে বিপুল। গোটা বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে তাঁর আন্দোলন। কিন্তু কতটা বদলেছে পাকিস্তানে (Pakistan) মেয়েদের জীবন? যাঁদের শিক্ষার জন্য মালালার এই জীবনপণ লড়াই?
উত্তরটা খুব একটা সদর্থক কিছু নয়। মাঝে ন’টা বছর চলে যেতে পারে। তবু পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই। ২০১৫ সালে ওসলোয় শিক্ষা ও উন্নয়ন নিয়ে হওয়া এক সম্মেলনে পাকিস্তানকে বলা হয়েছিল ‘শিক্ষার নিরিখে বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট’ দেশ। ২০১৮ সালে সরকার বদল হয়েছে। মসনদে বসেছেন ইমরান খান (Imran Khan)। ক্ষমতায় আসার আগে তাঁর দলের ইস্তেহারেই দাবি করা হয়েছিল, পাকিস্তানে ২ কোটি ২৫ লক্ষ শিশুরা স্কুলছুট হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে বিরাট অংশই মেয়েরা। সেই সময়ের এক পরিসংখ্যান বলছে ৩২ শতাংশ মেয়েরা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরতে না পেরতে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তারপর যত উপরের ক্লাস, তত সংখ্যা কমতে থাকে। দেখা যাচ্ছে ক্লাস নাইনে পৌঁছে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে! এই বছর দুয়েকে ছবিটা কিছুই বদলায়নি। ইমরানের সরকার পরিস্থিতি বদলের আশ্বাস দিলেও কোনও পরিবর্তনই হয়নি। বরং গত বছরের অতিমারী আরও ভয়ংকর করে দিয়ে গিয়েছে সেদেশের নারীশিক্ষার ছবিটাকে।
[আরও পড়ুন: ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়নি ভারত, জানিয়ে দিল নৌসেনা]
অথচ মালালা স্বপ্ন দেখেছিলেন বদলাবে ছবিটা। ২০০৮ সালে তালিবানরা (Taliban) ঘোষণা করে দিয়েছিল, মেয়েদের জন্য শিক্ষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ধ্বংস করে দিয়েছিল অসংখ্য স্কুল। মেয়েরা আবার পড়াশোনা করবে কী! সেই কর্কশ ও সর্বগ্রাসী ফতোয়ার জবাবে মালালার মতো কয়েকজন কেবল স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। শিক্ষার স্বপ্ন। মাথা উঁচু করে ভয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর স্বপ্ন।
নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে মালালার দৃপ্ত ঘোষণা ছিল, ”আমি কোনও একলা কণ্ঠস্বর নই। আমি বহু। আমি মালালা। আমিই শাজিয়া। আমিই কাইনাত। এ গল্প আরও অনেক মেয়ের গল্প।” শাজিয়া রমজান আর কাইনাত রিয়াজকে অবশ্য আমজনতা চেনে না। অক্টোবরের এক নরম দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় মালালার স্কুলবাসে যখন হাজির হয়েছিল আততায়ী এহসান তখন পঞ্চদশী মালালার পাশেই ছিল তার এই দুই বান্ধবী। শাজিয়া তখন ১৪ আর কাইনাত ১৬। বন্দুকধারীর ছোঁড়া গুলিতে তারাও আহত হয়েছিল। পরে মৃত্যুমুখে পতিত মালালার এই দুই বান্ধবীর মুখ থেকেই পৃথিবী শুনেছিল সেই ভয়ংকর মুহূর্তের গল্প। যা ওই বাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়নি। কাইনাতের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মালালা তো দেশে নেই। এবার তাঁরাই তালিবানদের লক্ষ্য। বাড়িতে থাকাটাই হয়ে উঠেছিল চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে কাইনাতের বাড়ির পাশে বোমা বিস্ফোরণের পরে প্রতিবেশীদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল এই মেয়ের জন্যই এলাকার শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। কেন যে এরা স্কুলে যায়? সেই কারণেই তো এত ক্ষুব্ধ তালিবানরা। খামোখা পাড়ার জনজীবন অশান্ত হয়ে পড়ছে।
[আরও পড়ুন: একটুর জন্য হয়নি যুদ্ধ, ভারত-চিন সীমান্তে গনগনে পরিস্থিতির বর্ণনা দিলেন সেনাকর্তা]
শাজিয়া-কাইনাতদের জীবনও বদলেছে। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে পড়াশোনার বৃত্তি তাঁদের সামনেও খুলে দিয়েছে উচ্চশিক্ষার দরজা। কিন্তু বাকিরা? মালালার নোবেলজয়ের মঞ্চে আবারও ফিরে যাই। নিজের পুরস্কারকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সেই সব শিশুদের যারা শিক্ষা চায়। সেই সব ভীত শিশুদের যারা শান্তি চায়। সেই সব অবলা শিশুদের যারা পরিবর্তন চায়। আজও সেই বিপন্নতাকে সঙ্গে করেই পথ চলতে হচ্ছে তাদের। এক অদ্ভুত সমাপতনের কথা বলি। মালালার নোবেলপ্রাপ্তির সপ্তাহখানেক পরেই পেশোয়ারে স্কুলের ফুটফুটে শিশুদের উপরে গুলির ছররা চালিয়ে ১৩২ জনকে মেরে ফেলেছিল তালিবানরা!
কেটে গিয়েছে আরও ছ’বছর। ক্ষমতায় আসীন ইমরান খান বিরোধীদের আন্দোলনের ধাক্কায় প্রবল চাপে। এদিকে তালিবান-সহ নানা জঙ্গির আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠায় ক্রমশ কোণঠাসা হতে হয়েছে পাকিস্তানকে। এসবের মধ্যেই আরও বেশি করে বিপন্ন হয়েছে মেয়েদের নিরাপত্তা। আর তত ক্ষীণ হয়েছে তাদের শিক্ষার ছবি। একে তো রাজনৈতিক অস্থিরতা, যখন তখন জঙ্গি হামলার আশঙ্কা কিংবা দারিদ্রের ছোবল। তার চেয়েও বড় ফ্যাক্টর মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেই এক তীব্র নিরাসক্তি। এদিকে সরকারি স্কুলের সংখ্যা সীমিত। ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি স্কুল গজিয়ে উঠলেও সেখানে পড়াশোনার মান একেবারেই নিম্নমুখী। ফলে কেবল মেয়েদের শিক্ষাই নয়, সামগ্রিক ভাবেই শিক্ষাব্যবস্থাই মুখ থুবড়ে পড়ার শামিল।
পরিস্থিতিকে আরও ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে করোনার থাবা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে মালালা আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, মেয়েদের শিক্ষা ও অন্যান্য যেসব বিষয় নিয়ে তিনি লড়াই চালাচ্ছেন তা এক ঘোরতর অন্ধকারের মুখোমুখি হয়েছে অতিমারীর কবলে পড়ে। সেই সময়ই তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, করোনা পর্ব শেষ হলে অন্তত ২ কোটি মেয়ে আর স্কুলে ফিরবে না! ফলে বোঝাই যাচ্ছে, কতটা ভয়াবহ হতে চলেছে আগামী দিনগুলো।
এই পরিস্থিতিতে ফের গর্জে উঠেছে এহসান। নিরস্ত অসহায় স্কুলছাত্রীদের উপরে গুলি চালিয়েও তাদের মেরে না ফেলতে না পারার আক্ষেপ তার যাচ্ছে না। জেল থেকে পালিয়ে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে মনের ভিতরে জিঘাংসা নিয়ে। টুইটারে তার উগরে দেওয়া ঘৃণা দেখে শিউরে উঠছে বিশ্ব। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মেয়েদের বিপন্নতার অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকার বিষয়টাই। অর্থাৎ পাকিস্তান রয়েছে ঠিক সেখানেই, যেখানে হয়তো তাদের থাকারই কথা ছিল। মালালাদের স্বপ্ন সত্যি হতে এখনও তাই দীর্ঘ দীর্ঘ অপেক্ষা। কিন্তু আরও কত দিন? কত বছর? প্রশ্নগুলো সহজ নয়। উত্তরও আপাতত অজানার গর্ভে।