অপরাজিতা সেন: বারবার সিনেমা কেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিতর্ক। ‘কাশ্মীর ফাইলস’, ‘কেরালা স্টোরি’, অধুনা ‘বেঙ্গল ডায়েরি’। আমি ‘বেঙ্গল ডায়েরি’র ট্রেলার দেখেছি, সোশ্যাল মিডিয়ায়। ওটা সিনেমা নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কুৎসিত মিথ্যাচার। উদাহরণ, ওরা দেখাচ্ছে রাজ্য সরকার দুর্গাপুজোকে ছোট করছে, বিসর্জনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ভিত্তিহীন। বলছে না, মুখ্যমন্ত্রী পুজো-অর্থনীতি সচল রাখতে সব পুজো কমিটিকে টাকা দেন, করোনায় টাকা বাড়ান, বিসর্জনে আন্তর্জাতিক কার্নিভাল করেন, ইউনেসকোর ঐতিহ্যের স্বীকৃতি আদায় করে এনেছেন।
এরকম প্রতি ক্ষেত্রেই বাংলা সম্পর্কে কুৎসা আর বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রের রিপোর্টে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে বাংলা প্রথম পুরস্কারে, এসব নেই। বাম জমানার অত্যাচার, অপশাসন ওরা দেখতে পাচ্ছে না। কেন্দ্রের বঞ্চনাও ওদের চিত্রনাট্যে নেই। উলটে এতে আছে ধর্মীয় মেরুকরণের বিষ ঢালা উসকানি। এর সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্প বা শিল্পী স্বাধীনতার কোনও সম্পর্ক নেই। প্রতিবাদ হবেই। এই লেখায় অবশ্য বিষয় একটু অন্য।
কাশ্মীর, কেরল বা বাংলা নিয়ে এই যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিনেমা, এটা করছেন কারা? করছেন কেন? নিশ্চিতভাবেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজেপির মনোভাব এবং পার্টিলাইনের সমর্থক প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা করছেন। বিজেপি যে চিন্তাটার প্রচার ও প্রসার চায়, প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেই কাজটাই পেশাদারি মোড়কে করছেন তাঁরা। এতে একদিকে যেমন সিনেমার মধ্যে দিয়ে বিজেপি, আরএসএসের ভাবধারার প্রচার চলছে; তেমনই এর প্রতিবাদ হলে বিতর্ক তৈরিতে যে মেরুকরণ, তাতেও তাদেরই লাভ।
[আরও পড়ুন: কমল হাসান বোকা! ‘কেরালা স্টোরি’র নিন্দা শুনে দক্ষিণী তারকাকে তোপ পরিচালক সুদীপ্তর]
এখানেই প্রশ্ন, বিজেপির ভাবধারার পরিচালক বা শিল্পীরা যদি পেশাগতভাবেও কাজ করে উদ্দেশ্যসাধনের পথ প্রশস্ত করেন, তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের এত শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজকরা কি আঙুল চুষছেন? বেঙ্গল ফাইলস যদি করতেই হয়, বাম জমানার সন্ত্রাস, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই, এত নাটকীয় উপাদান, এখন রাজ্যে এত কর্মযজ্ঞ, ২০২১-এর ঐতিহাসিক যুদ্ধ, কেন্দ্রের ষড়যন্ত্র, একটাও ভাল ছবি হল না কেন? বিজেপি, আরএসএসের বিরুদ্ধে ভাবনাগত বিরোধিতার ছবি কি টলিউডের কেউ দিতে পারত না? এমন একটা সিনেমা, যার চিত্রনাট্যে প্রতিষ্ঠিত থাকবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই, সেটা করা গেল না? অথচ মুখ্যমন্ত্রীর চারপাশে টলিউডিদের ভিড়, হাতিবাগানের পুজোর বাজারের মতো।
মনে আছে, বহু বছর আগে, তখন ভরা বাম জমানা, সিপিএম নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্য নিজে পরিচালনা করে একটি ছবি করেছিলেন। এক যুবক প্রবাসে গিয়েছিল, ফিরে কী উন্নয়ন আর পরিবর্তন দেখছে। একটু ডকু-টাইপ ছিল বটে, কিন্তু চেষ্টা চমৎকার। আলিমুদ্দিনের তিন তলায় প্রথম প্রদর্শন, অনিল বিশ্বাসও বসে দেখেছিলেন। ছবির নাম ‘নবারুণ’, নাম ভূমিকায় প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে না থেকেও নেপালদেব যেটা ভেবেছিলেন, (যদিও পরে মিঠুনদাকে দিয়ে ‘চাকা’ নামে একটি সিনেমা করেছিলেন নেপালদা), সেটা তৃণমূলের টলিউডিরা করেন না কেন? অনেক আগে ২০১১ নাগাদ, শতাব্দী রায়, তাপস পাল তাঁদের ‘পরিবর্তন’ ছবিতে এরকম একটু ছাপ রাখতে গিয়েছিলেন। সেন্সর বোর্ডে থাকা দলেরই দু’-একজনের জন্য ওই ছবিকে যা সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, তাতে শতাব্দীর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। তিনি ওই পথে আর যাবেন না।
২০১১-তে তিনটি যাত্রাপালাও হয়েছিল বটে। পরে একজন নবীন পরিচালক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘিরে ছবির একটা চেষ্টা করেছিলেন, সেভাবে দাঁড়ায়নি। ব্রাত্য বসু কিন্তু তাঁর কিছু নাটক ও ছবিতে এমন বার্তা রেখেছিলেন, যা সন্ধিক্ষণে তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছিল। এখনও সুযোগ এলেই এটা করার মানসিকতা ওর আছে। তবে, পেশাদারি গল্পের মধ্য দিয়ে আসল বার্তা স্পষ্ট করে দেওয়া, এটা করতে পারতেন টলিউডের বাণিজ্যিক ধারার প্রথম সারির তারকারা। এই যে কন্যাশ্রী থেকে রূপশ্রী, অসংখ্য স্কিমে প্রান্তিক পরিবারগুলিকে স্বনির্ভর করা, মহিলাশক্তির উত্থান, যে কোনও বিষয় বা চরিত্রকে ধরে সার্বিক পরিবর্তন এবং আদর্শগত লড়াইটা বড়পর্দায় তুলে আনা যায় না? অবশ্যই যায়। কিন্তু করা হয়নি।
[আরও পড়ুন: রাজপথে কুস্তিগিরদের হেনস্তা! ‘অগণতান্ত্রিক’, ‘কালো দিন’, ফুঁসে উঠলেন কমলেশ্বর-রাহুল]
মুখ্যমন্ত্রীর পাশে প্রযোজক, পরিচালক, নায়ক, নায়িকা দেখি; তাঁদের সম্মান দেন মুখ্যমন্ত্রী; অনেকে এমপি, এমএলএ হয়েছেন; অনেকে অনেক পদে; শুধু যথাযথ একটা ‘বেঙ্গল টাইমস’ করার কথা ভাবেন না। উলটে বিজেপিতে নাম লেখানো দলবদলু অভিনেতা, যিনি নেত্রী এবং তৃণমূলকে আক্রমণ করে চলেছেন, তাঁর সঙ্গে শিল্পী স্বাধীনতার নামে ছবি করে আদিখ্যেতা দেখান। টলিউডি তারকারা নিশ্চয়ই তারকা, কিন্তু রাজনীতি বা জনপ্রতিনিধিত্বে এসে তাঁদের সম্মান, গুরুত্ব, পরিসর আরও বেড়েছে, অস্বীকার করতে পারেন? উলটে এমন অভিযোগও আসছে, দলের নেতাদের আমন্ত্রণে আসতে তাঁদের কেউ কেউ শিল্পীজনিত পারিশ্রমিক নিচ্ছেন, এমনকী ভোটপ্রচারে এলেও। যে প্রযোজক, পরিচালক, তারকারা মুখ্যমন্ত্রীর পারিষদের ভূমিকায় থেকে নিজেদের ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের মার্কেটিং করেন, প্রভাব বাড়ান, কাজ বাড়ান, কমিটিতে যান, তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে এতদিনে একটা আসল ‘বেঙ্গল টাইমস’ উপহার দিতে পারলেন না?
বিজেপির ভাবধারায় পরপর ছবি হবে, আমরা বিরোধিতা করব, এভাবেই চলবে। টলিউড তো এসবের কড়া প্রতিবাদেও নেই, নতুন কোনও অবদান সৃষ্টিতেও নেই। ওই ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ, কোনও অ্যাওয়ার্ড মঞ্চ বা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে সহাস্যে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করা ছাড়া টলিউডি তারকাদের, যাঁরা নিজেদের তৃণমূলবৃত্তে দেখান, অন্তত ভাবভঙ্গি করেন, তাঁদের কি আর কিছুই করার নেই? আমি এই আলোচনায় কখনওই কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, অনীক দত্ত, চন্দন সেন, বাদশা মৈত্রদের অন্তর্ভুক্ত করব না, কারণ তাঁরা স্পষ্টতার সঙ্গে ভিন্নমতের পথিক। কিন্তু, যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর বৃত্তে থাকেন, তাঁরা কেন একটা সত্যিকারের ‘বেঙ্গল ফাইলস’ মুখ্যমন্ত্রীকে উপহার দেবেন না?