সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ৯ বছর পার হয়ে গেল। স্বজন হারানো কান্নার অনুরণন এখনও বাণিজ্য নগরের বাতাসে। যন্ত্রণার গোঙানি এখনও গিলে খেতে আসে আরব সাগরের তীরের না ঘুমনো শহরকে। ২০০৮ থেকে ২০১৭, এই ৯ বছরে অনেক কিছু পালটেছে। মেট্রো থেকে মনোরেল, ক্ষমতার অলিন্দে মুখবদল, ধর্মের ধ্বজাধারীদের আস্ফালন বৃদ্ধি। কিন্তু বদলায়নি মানসিকতা। মোছেনি স্মৃতি। ক্ষত এখনও শুকোয়নি মুম্বই শহরের। ৯ বছর আগে আজকের দিনে রক্তাক্ত হয়েছিল স্বপ্ননগরী। পাক জঙ্গিদের অতর্কিত হামলায় ১৬৬টা তরতাজা প্রাণের বলি ভুলবে কী করে মানুষ। তাই আজও ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে সেদিনের বিভীষিকার সাক্ষীরা। এই প্রতিবেদনে রইল সেইসব মানুষের অভিজ্ঞতার কথা।
বিষ্ণু দত্তারাম জেণ্ডে। মুম্বইয়ের লাইফলাইন ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে কর্মরত সাব-আরবান ডিভিশনের এক কর্মচারী। ৯ বছর আগের সেই অভিশপ্ত দিনেও তিনি টার্মিনাসেই কর্তব্যরত ছিলেন। জঙ্গি হামলা বুঝতে পেরেই অনবরত হিন্দি ও মারাঠিতে যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঘোষকের কাজ করেছিলেন। বারবার যাত্রীদের প্রধান দরজার বদলে পিছনের গেট দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে গিয়েছিলেন। ২৫ মিনিট অনর্গল ঘোষণা। সেদিনের বীরত্বের সম্মানে জুটেছিল পদোন্নতি, রেলমন্ত্রীর হাত থেকে আর্থিক পুরস্কার। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে দেখা করার সুযোগও আসে। কিন্তু আজও সেদিনের ঘটনা এড়িয়ে যেতে চান বিষ্ণু। কর্মনিষ্ঠ ও সৎ কর্মী হিসাবে সেদিন যা করার তাই করেছিলেন বলে মনে করেন তিনি। এখনও বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে যান, ‘ভবিষ্যতেও ফের এমন মুহূর্ত এলে আবারও নিজের কর্তব্যকেই আগে রাখব। এ নিয়ে কোনও সংশয়ের জায়গা নেই।’
রহিম আনসারি। এক লহমায় তাঁর হাসিখুশি পরিবারে সেদিন নেমে এসেছিল শোকের কালো ছায়া। জঙ্গিদের গুলিতে পরিবারের ছয় সদস্য লাশে পরিণত হয়েছিল ৯ বছর আগে। ঘটনার পর মানসিক অবসাদে চলে গিয়েছিলেন তিনি। পরিবারের কেউই বাঁচার সুযোগ পায়নি। এতদিন পর তাঁর একটাই স্বস্তি, দোষীরা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু তাঁর মতে, ‘শয়তান হাফিজ সইদটা এখনও বেঁচে। পাকিস্তান থেকে যদি ভারত সরকার ওকে ধরে শাস্তি দিতে পারে তবেই জ্বালা জুড়োবে।’ গলায় প্রতিশোধস্পৃহার স্ফুলিঙ্গ তাঁর।
তখন তাঁর ৯ বছর বয়স। তবুও ৯ বছর আগে শৈশবের স্মৃতি এখনও টাটকা অষ্টাদশী দেবিকার। হবে না কেন, জঙ্গিদের গুলি তখন রেয়াত করেনি তাকেও। কিন্তু মৃত্যুকে হার মানিয়েছিল সে।’যখন কাসভকে আদালতে দেখি, তখন ভিতরে আগুন জ্বলে ওঠে। মনে হচ্ছিল, যদি একটা বন্দুক থাকত ওখানেই ওকে গুলি করে মারতাম। যদিও কাসভ তো একটা মশা। সন্ত্রাসের চাঁইগুলোকে আগে ধরতে হবে।’ পাশে রাখা সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার, বীরত্বের সম্মানস্মারক গুলির দিকে চেয়ে বহুদিনের চেপে রাখা ক্ষোভ উগরে দিলেন সদ্য তরুণী দেবিকা।
মহম্মদ তৌফিক। পেশায় চা-বিক্রেতা। রুজির টানে ৯ বছর আগের ২৬ নভেম্বরও শিবাজি টার্মিনাসের বাইরে চা-বিক্রি করছিলেন তিনি। একা হাতে বহু জখম মানুষকে উদ্ধার করেছিলেন সেদিন। পরিস্থিতি প্রতিকূল ছিল। ছিল না এত ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপের রমরমা। মেসেজ করে দ্রুত সাহায্য চাওয়া তাই ছিল দূর অস্ত। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর সাহসিকতা অবাক করেছিল মুম্বইকরদের। স্মৃতি ঘেঁটে তিনি বলেন, ‘এখনও সেদিনের কথা মনে করলে গায়ে কাঁটা দেয়। শুধু সেইদিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন পাকিস্তানে বসে থাকা শয়তানটা ধরা পড়বে।’
এরাই ছিলেন সেদিনের রক্তাক্ত মুম্বইয়ের মুখ। এমন হাজারো সাহসী ছড়িয়ে রয়েছে শহরে। ইয়ত্তা নেই তাঁদের সাহসিকতার। কিন্তু সবার নজরে যে সেই হাফিজকেই মুক্তি দিল পাক আদালত। ফের একবার সেদেশের অপদার্থতা বেআব্রু হয়ে গেল। সেদিনের স্মৃতিতে এদিন শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। স্মৃতি, শ্রদ্ধার্ঘ এসবই এখন সম্বল সেদিনের হিরোদের। ক্ষত ভরতে ৯ বছর দীর্ঘ সময়। কিন্তু মুম্বই কখনও কিছু ভোলে না। আজও ভোলে নি।
The post ৯ বছর পার, মুম্বই হামলার ক্ষত এখনও তাজা এই সাহসীদের মনে appeared first on Sangbad Pratidin.