সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ১৯৯৮। পোখরানে সফল ভারতের পরমাণু পরীক্ষা। যে সাফল্য পশ্চিমী দুনিয়ায় চক্ষুশূল করে তুলল ভারতকে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সির নিষেধাজ্ঞা, পশ্চিমী দুনিয়ার 'বয়কট', আমেরিকা-সহ অন্যান্য পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির রক্তচক্ষু। সব মিলিয়ে ভূরাজনীতিতে বেশ চাপে পড়ে গিয়েছিল ভারত। অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সেই সম্পর্ক শুধরে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বটে, কিন্তু ইউরোপ বা বিশ্বের দরজা তিনি ভারতের জন্য খুলতে পারেননি।
সেসময় মনমোহন সিং (Manmohan Singh) বিরোধী শিবিরে। রাজ্যসভার একাধিক ভাষণে তিনি বুঝিয়েছিলেন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সুদৃঢ় করতে এবং ভূরাজনীতিতে ভারতের গুরুত্ব বাড়াতে, পশ্চিম-সহ গোটা বিশ্বের দরজা ভারতের জন্য খুলে যাওয়া কতটা জরুরি। ২০০৪ সালে খানিক পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে আসে তাঁর কাছে। বিরোধী শিবিরে থাকাকালীন যে কাজের গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করেছিলেন, সেটাই এবার করে দেখানোর সুযোগ। সময় নষ্ট না করে সবার প্রথম আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করলেন তিনি। কাজটা সহজ ছিল না। আমেরিকা তখন পাকিস্তানের 'বন্ধু'। আর ভারত বন্ধু রাশিয়া বরাবরই মার্কিন বিরোধী। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের দরজা খুলতে চাইলে রাশিয়ার রোষে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেসব আশঙ্কার মধ্যেই ডঃ সিং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।
মনমোহন সিং বুঝেছিলেন, আমেরিকার সঙ্গে অসামরিক পরমাণু চুক্তি করতে পারলে সেটা যে শুধু ভারতের শক্তি চাহিদা পূরণ করবে, তাই নয়। একই সঙ্গে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে তথা পশ্চিমী দুনিয়ার নজরে ভারতের 'অছ্যুৎ' তকমাটাও কেটে যাবে। মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতে পারলে এক ধাক্কায় ভূরাজনীতিতে ভারতের গুরুত্ব অনেকটা বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে তিনি আমেরিকাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, ভারতের বাজার আমেরিকাকে আর্থিকভাবে বিরাট ফায়দা দিতে পারবে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সখ্য চিনের দিকে কড়া নজর রাখতে সাহায্য করবে আমেরিকাকে। ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই যৌথ বিবৃতিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং মনমোহন সিং পরমাণু চুক্তির কথা ঘোষণা করেন।
কিন্তু সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হতে সময় লেগে গেল ৩ বছর। ২০০৮ সালের অক্টোবরে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং মার্কিন বিদেশ সচিব কন্ডোলিজা রাইসের মধ্যে অসামরিক পরমাণু চুক্তি সম্পন্ন হয়। আসলে এই ৩ বছরে অনেক ঝড় সহ্য করতে হয়েছিল ভারতের 'অ্যাকসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার'কে। আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করতে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি এজেন্সির (IAEA) ছাড়পত্রের প্রয়োজন ছিল। যা জোগাড় করাটা ভারতের পক্ষে চাট্টিখানি কথা নয়। কারণ ওই আন্তর্জাতিক সংস্থা আগেই ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
এদিকে দেশের অন্দরে মনোমোহন সিংকে সরকার বাঁচানোর লড়াই লড়তে হচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না তৎকালীন ইউপিএ সরকার পুরোপুরি জোট নির্ভর। কংগ্রেস সেই সরকারের 'চালিকাশক্তি' হওয়ার মতো শক্তিশালীও ছিল না। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই সেটার বিরোধিতা শুরু করে প্রকাশ কারাট-সীতারাম ইয়েচুরিদের বামফ্রন্ট। সেই ইউপিএ সরকারের প্রধান শরিক ছিল বামেরা। কোনওভাবেই পরমাণু চুক্তি করা যাবে না, এই দাবিতে সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেন কারাটরা। অবধারিতভাবে সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। একই সঙ্গে প্রশ্নের মুখে পরমাণু চুক্তির ভবিষ্যৎ। কিন্তু খানিক চমকপ্রদভাবে সমাজবাদী পার্টির সমর্থনে সরকার বেঁচে যায়। সরকারের পক্ষে ভোট দিয়ে দলছাড়া হতে হয়ে স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। শুধু বামফ্রন্ট নয়, শোনা যায় সরকার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় 'ম্যাডাম'ও চুক্তি থেকে পিছিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেসব বাধা পেরিয়ে পরমাণু চুক্তি চূড়ান্ত করে ফেলেন মনমোহন। যা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর অন্যতম বড় সাফল্য।
আজকের ভারত যে 'বিশ্বগুরু' অবতারে ভূরাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সেটার নেপথ্যে সেদিনের ওই পরমাণু চুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। ওই পরমাণু চুক্তিই পশ্চিমী দুনিয়ার দরজা নতুন করে খুলে দিয়েছিল ভারতের জন্য। আমেরিকা এবং ভারতকে কাছাকাছি এনেছিল ওই চুক্তি। আজ মনোমোহনের প্রয়াণের পর সে কথা বলছে আমেরিকাই। মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলছেন, "আমেরিকা এবং ভারতকে কাছাকাছি এনেছিলেন তিনি।" আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে গিয়ে রাশিয়ার বন্ধুত্বও হারাতে হয়নি ভারতকে। সব মিলিয়ে ওই চুক্তি ভারতকে এমন এক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল, যেখান থেকে বিশ্ব কূটনীতির সব অক্ষের সঙ্গেই সুসম্পর্কের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। সেই ভিত্তিকেই আজ কাজে লাগাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি।