কৌস্তভ দেবনাথ, পর্যটক: কাশ্মীরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই খবরটা পেলাম। এক মুহূর্তের জন্য আঁৎকে উঠেছিলাম। ভয় হচ্ছিল পরিবার নিয়ে সুস্থভাবে ফিরতে পারব তো! একের পর খবর ভিডিও-খবরগুলো যখন আসছিল, আতঙ্ক যে বাড়ছিল না সেটা বললে মিথ্যা বলা হয়। কিন্তু পরে বুঝলাম এটাই তো ওরা চাইছে। এই ভয়টাই তো জঙ্গিদের পুঁজি। বেশিরভাগ কাশ্মীরবাসী সন্ত্রাস চায় না। পর্যটকদের আতঙ্কে ওদেরও ভয়।
এবারে কাশ্মীরে এসেছিলাম লম্বা ছুটি নিয়ে। আগামী ৭ মে আমাদের ফেরার ফ্লাইট। ভেবেছিলাম শ্রীনগর হয়ে শোনমার্গ হয়ে পহেলগাম, সবটাই ঘুরে দেখব। ভূস্বর্গের সব স্বাদ আস্বাদন করেই ফিরব। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের ঘটনা স্তম্ভিত করে দিল। ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য ভাবতে পারছিলাম না, কী করনীয়। ভয়টা কাটতে অনেকটা সময় গিয়েছে। আসলে রাত থেকে অনেকেই এসেছেন। আমাদের হোটেলের কর্মীরা বারবার এসে অভয় দিয়ে গিয়েছেন। একজন এসে বলে গেলেন, "ভয় পাবেন না। আমরা সকলেই আপনাদের সঙ্গে আছি। কাশ্মীর সন্ত্রাস চায় না। ১০০ জনের মধ্যে একজন খারাপ হতে পারে। সবাই নয়।" খানিক সাহস পেলাম। আসলে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে এসেছি। আমার সন্তান আবার স্পেশাল চাইল্ড। ভয় তো একটা ছিলই। কিন্তু সকলের অভয়বাণী পেয়ে সেই ভয় কাটিয়ে আজ বেরিয়ে পড়লাম।
শ্রীনগর আজও থমথমে। পহেলগাম হামলার প্রতিবাদে স্বতঃপ্রণোদিত বনধ ডেকেছেন স্থানীয়রা। দোকানপাঠ বন্ধ, যানবাহন চলাচলও কার্যত বন্ধ। এর আগেও বহুবার কাশ্মীরে এসেছি। শ্রীনগরে পর্যটকদের যে ভিড় চোখে পড়ে, সেটা এবার দেখলাম না। স্বাভাবিক। আতঙ্কে অনেকেই কাশ্মীর ছাড়ছেন। দ্রুত ফেরার বিমান ধরার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। সুযোগ নিচ্ছে বিমানসংস্থাগুলিও। হু হু করে বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। এই বিপদের সময় যারা এভাবে ব্যবসায়ীক স্বার্থ দেখছে, আমার মনে হয় তারাও জঙ্গিদের থেকে কম কিছু নয়। যা-ই হোক, শ্রীনগরের রাস্তায় নিরাপত্তার ছবিটা আগের মতোই। হয়তো একটু বেশি কড়াকড়ি। একটা চাপা আতঙ্কের পরিবেশ, গুমোট ভাব রয়ে গিয়েছে। কিন্তু গুটিকয়েক যে পর্যটক বেরিয়েছেন তাঁদের কোনও অসুবিধা আজও হয়নি। বনধ থাকলেও পর্যটকদের আটকায়নি কেউ। আমরা বেরিয়েছিলাম, স্বচ্ছন্দে এবং নির্ভয়েই ঘুরে এলাম। আর দেখলাম স্থানীয়দের ক্ষোভ, বিরক্তির ছবি। পহেলগাঁও গোটা দেশকে যেমন আঘাত করেছে, কাশ্মীরকেও আঘাত করেছে। আজ পর্যটনকে কেন্দ্র করেই এই মানুষগুলির বেঁচে থাকা, তাঁদের রুজিরুটি। জীবনযাত্রার মান যেটুকু বদলেছে, সেটাও এই পর্যটনকে কেন্দ্র করেই। ওরা জানেন, এই জঙ্গি হামলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি তাঁদেরই। এরপর যদি আতঙ্কে পর্যটকরা ভূস্বর্গে যাওয়া বন্ধ করে দেন, তাহলে পেটে লাথিটা তাঁদেরই পড়বে। সন্ত্রাসের করাল ছায়া সবার আগে তাঁদেরই রুজিরুটি গ্রাস করবে। বারবার তাই সকলেই আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। কাতর স্বরে বলে গেলেন, 'গুটিকয়েক জঙ্গির জন্য গোটা কাশ্মীর যেন শাস্তি না পায়।'
ফিরে এলাম হোটেলে। মনে হল, সত্যিই তো ওদের আর কী দোষ। ঠিক করলাম, এখনই বাড়ি ফিরব না। তাছাড়া সরকারও তো পর্যটকদের জন্য কোনও নির্দেশিকা জারি করেনি। কাউকে কাশ্মীর ছাড়তেও বলা হয়নি। একটু নাহয় প্রশাসন এবং নিরাপত্তারক্ষীদের উপর আস্থা রাখলাম। এই লোকগুলির পাশে দাঁড়ানোর জন্যই নাহয় একটু সাহস দেখালাম। আপাতত পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি। প্রশাসন কোনও নির্দেশিকা দিচ্ছে কিনা সেদিকে তাকিয়ে আছি। এখনই ভূস্বর্গ ছাড়ছি না। ২৬ তারিখ আমার পহেলগাঁও যাওয়ার কথা। বৈসারন ভ্যালি হয়তো যাওয়া হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পহেলগাঁও যাব। ঘুরে দেখব আমার প্রিয় কাশ্মীর।
