সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: অভিধান দু-মলাটে বন্দি। ভাষা নয়। লেখার ভাষা তাও কিছু নিয়মের নিগড়ে বাঁধা। কথার ভাষায় বাঁধ পরায় কে! অতএব বাঙালির মুখে হু-হু করে ঢুকে পড়ছে এমন অনেক ভাষা, অভিধান হয়তো টেরও পায় না। কিন্তু সময়ের স্রোতে হাত রাখলে, তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। ভাবপ্রকাশই যদি ভাষার প্রধান লক্ষ্য, হয় তবে এরা বেশ কার্যকরী। দিব্যি মিলেনিয়াল জেনারেশনের মুখ থেকে মগজে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রয়োজনীয় অর্থও ডিকোড হচ্ছে। এখন তা ভাল কি মন্দ, সে বিস্তর তর্কের বিষয়। আপাতত সেসব মুলতুবি রেখে চোখ রাখা যাক, এরকম বেশ কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধের দিকে।
১) ক্রাশ খাওয়া- ‘বঁধু কোন আলো লাগল চোখে’ গোছের ব্যাপার। তবে রবি ঠাকুর মাথায় থাকুন। এখন আর সে পংক্তিতে কেউ হাতড়ে বেড়ান না। হালকা প্রেমের আঁচ বোঝাতে তাই ‘ক্রাশ খাওয়া’ বললেই চলে। যেমন, উফফ প্রিয়া ভারিয়েরকে কী দেখতে! প্রথম দেখাতেই ক্রাশ খেলাম।
২) গোলা- দারুণ কিছু বোঝাতে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় এ শব্দ। সুন্দরী তণ্বীকে দেখে তাই ইয়ং বং-ব্রিগেড আর ‘কে তুমি নন্দিনী’র ধারবার মাড়ায় না। বরং বলে ‘গোলা দেখতে’। ভাল খাবারেও তাই সই। বন্ধুনির রান্না কোনও নতুন পদ মুখে তুলে তাই প্রতিক্রিয়া, গোলা খেতে হয়েছে রে…।
[অমর একুশে শ্রদ্ধা এপার বাংলাতে, আবেগে ওপার]
৩) বিলা– ‘কৃষ্ণ করলে লীলা, আর আমরা করলে বিলা’- মনে আছে লাইনটা? তরুণরা শব্দটিকে তাঁদের নিজস্ব অভিধানে তুলে নিয়েছে। কেউ খুব ভাল আছে বোঝাতে আকছার তাই বলা হয়, বিলা আছিস ভাই!
৪) কেন কি- বিবিধের মাঝে মহামিলন বলা যায় আর কী! হিন্দির ‘কিউঁ কি’ মুখে মুখে ‘কেন কি’ হয়ে গিয়েছে। কেননা বাঙালি এখন বিশুদ্ধ বাংলার বদলে মিশ্রণে বিশ্বাসী। তাই কেননাকে লাথি মেরে মুখে মুখে এখন কিঁউ কি।
৫) ভোট করুন- বঙ্গের দেওয়াল এখনও ভরা ‘এই চিহ্নে ভোট দিন’ লেখায়। কিন্তু ওই যে বাঙালি বিশ্বমানব হয়ে ওঠার লক্ষ্যে। অতএব কাস্ট ইওর ভোট-এর বাংলা করে ‘ভোট করুন’ বলতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।
৬) সিপিয়েম- কিঞ্চিত রাজনৈতিক শ্লেষ জড়িয়ে আছে এ শব্দে। ক্ষয়িষ্ণু কোনও কিছু বোঝাতে তরুণদের মধ্যে এ শব্দের প্রয়োগের ছড়াছড়ি। বঙ্গীয় রাজনৈতিক জলহাওয়ার জেরেই এ শব্দের অবতারণা। ইদানিং হোয়্যাটসঅ্যাপেও একটা রসিকতা ছড়াচ্ছে যে, প্রেমিক নাকি প্রত্যাখানে আত্মহত্যার হুমকি দিতে গিয়ে বলে, পুরো সিপিয়েম হয়ে যাবো। মনে করুন সেই চন্দ্রবিন্দুর গান, ‘তুমি আমার সিপিয়েম, তুমি আমার এটিএম’। বলা বাহুল্য, সে গানের কথাও পালটে ফেলেছেন বাঁধনদার।
৭) ভারতী ঘোষ- এখানেও রাজনৈতিক কটাক্ষ বর্তমান। কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলে পাজি- এ প্রবাদের সংক্ষিপ্ত রূপ হয়ে উঠেছে ভারতী ঘোষ। যত দোষ নন্দ ঘোষ –এই প্রবাদ বোঝাতেও হোয়্যাটসঅ্যাপে এই শব্দের ব্যবহার চলছে। ঘুরছে রসিকতাও।
৮) ঝেলতে- কষ্টকর কোনও কিছু বয়ে বেড়ানো বোঝাতে এই শব্দের প্রয়োগ। যেমন, ধরুন প্রেমিকা যদি মাত্রাতিরিক্ত ন্যাকা হয়, তবে প্রেমিকপ্রবর মনে মনে ভাবে, দিনভর এখন একে ঝেলতে হবে। কিংবা বউকে নিয়ে শপিং করতে গেলে….বাকিটা আর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
৯) জুগাড়- আয়োজন বোঝাতে এ শব্দের ব্যবহার। এককালে, যাকে জোগাড়যন্ত্র বলত লোকে। এখন তাই-ই জুগাড়। যেমন কিট্টি ব্যাগ থেকে বেরনো পয়সা কড়ি দিয়েই মাসের বাকিটা চালাতে হবে। ওটুকুই জুগাড়।
[কেমন আছেন পাকিস্তানের হিন্দুরা?]
১০) ইমো– অনুভূতির তারে ঘা দেওয়াকে এক কথায় ইমো বলা হচ্ছে। যেমন, এককালে যাকে দেখে বুকের বাঁদিকে চিনচিনে ব্যথা, এখন হয়তো সে বিবাহিতা। তবু ফেসবুকে তাকে দেখলে এখটু ইমো তো লাগে। সোজা কথায়, ইমোশনাল-এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
১১) ফিলস দিচ্ছে- এও অনুভূতি প্রকাশের বর্ণমালা। কোনও কিছু দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লে এ কথার ব্যবহার হয়। যেমন, আহ ওদের ভ্যালেন্টাইনস ডে সেলিব্রেশনটা খুব ফিলস দিচ্ছে।
১২) গোলস- লক্ষ্য বোঝাতে এ শব্দের ব্যবহার। অ্যাম্বিশনও বলা যায়। যেমন, মিউজিক নিয়ে তোর গোলসের সঙ্গে আমার ভাবনা মেলে না।
১৩) ঘ্যাম বা ঘ্যামা- এই শব্দের প্রচলন অবশ্য বেশ কিছুদিনের। দারুণ কোনও কিছুকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। যেমন, মেয়েটি ঘ্যাম সেজেছে তো। বা সে ঘ্যামা দেখতে। আবার কারও অহংকার, ঔদ্ধত্য বোঝাতেও বলা হয়, ওর তো খুব ঘ্যাম।
১৪) জমে ক্ষীর- আগে বলা হতো জমে দই। এখন তা হয়েছে জমে ক্ষীর। ধরা যাক সরস্বতী পুজোয় এক যুগলের বেশ মাখামাখি। দেখে তাদের দুই বন্ধুর ফিচেল হাসিতে বক্তব্য, কেস তো পুরো জমে ক্ষীর।
১৫) লাইকালাম, ট্যাগালাম- সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এ শব্দের উৎপত্তি। লাইক বা ট্যাগ করার সঙ্গে বঙ্গীয় অনুভূতি যোগ করে তৈরি হয়েছে লাইকালাম বা ট্যাগালাম। অর্থাৎ লাইক করলাম বা ট্যাগ করলাম। যেমন, ছবিটায় তোকে ট্যাগালাম, আপত্তি নেই তো?
১৬) নেভানো, মানানো- জেন ওয়াইরা আজকাল আর জন্মদিন পালন করে না, মানায়। এই যেমন জন্মদিনটা দারুণভাবে মানানো হল। আবার ভালবাসা নেভাতেও জানে তারা। না, মোমবাতি নিভিয়ে ফেলার মতো নয়। মানে ভালবাসার মান রাখা।
১৭) জিও- মোবাইল দুনিয়ায় মুকেশ আম্বানির সংস্থার বিপ্লবের আগে থেকেই এ শব্দের ব্যাপক ব্যবহার চলছে। দারুণ কিছু, ফাটাফাটি ব্যাপার বোঝাতে এর চল। যেমন, জিও কাকা, ফাটিয়ে দিয়েছিস তো পুরো।
[আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহিদ স্মরণে বাংলাদেশ]
১৮) ছকানো- কোনও কিছু পরিকল্পনা করা। বিশেষত প্রেমের ক্ষেত্রে তরুণদের মধ্যে এর চল বেশি। যেমন, আমার ক্রাশকে ও কেন ছকানোর জন্য ঘুরঘুর করছে? ছকবাজের কীর্তিকে এক ক্রিয়ায় প্রকাশ।
১৯) ফিল্ডিং দিচ্ছে- কেউ কারও পিছনে ঘুরঘুর করছে বোঝাতে এ শব্দের প্রয়োগ। যেমন বলা হত, ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছে। আজকাল বলা হয়, ক্লাসে নতুন মেয়েটার তো পিছু ছাড়ছে না রে, সারাক্ষণ ভালই ফিল্ডিং দিচ্ছে।
২০) সোয়্যাগ- অহংকার, স্টাইল বা ঔদ্ধত্য বোঝাতে এ শব্দের প্রয়োগ। যেমন, ওই প্রজেক্টের ছেলেপিলের চালচলন দেখেছিস, পুরো সোয়্যাগ।
২১) অ্যাপো ও ব়্যাপো- প্রথমটি অ্যাপয়ন্টমেন্টের সংক্ষিপ্ত রূপ। ডেটিংয়ের ক্ষেত্রেও যুগলরা ব্যবহার করে থাকেন। যেমন, কীরে কোথায় বেরচ্ছিস, অ্যাপো আছে? আর দ্বিতীয়টির ব্যবহার ভাল সম্পর্ক বোঝাতে। যেমন, ওকে গিয়ে বল না হয়ে যাবে, অমুকবাবুর সঙ্গে তো ওর ভালই ব়্যাপো।