কৃশানু মজুমদার: এত ব্যাক পাস, এত স্কোয়্যার পাস! বিশ্বকাপ যত এগোবে, খেলা তত ভাল হবে বলেই আশা রাখি।
– রাত সাড়ে বারোটায় খেলা। ওই রাতে খেলা দেখা যায় নাকি! জাপান কিন্তু দুটো বিশ্বজয়ী দলকে হারিয়ে দিল।
একটা কথার সঙ্গে আরেকটা কথার কোনও মিল নেই। কিন্তু এক নিশ্বাসে বলে চলছিলেন সৈয়দ নইমউদ্দিন (Syed Nayeemuddin)। তাঁর দলও যে ১৯৭০ সালের এশিয়ান গেমসে (Asian Games) জাপানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছিল। তিনি ছিলেন জাতীয় দলের অধিনায়ক।
কেমন ছিল সেই ম্যাচ? নইমউদ্দিন চুপ। নিজেদের সোনালি অতীতের কথা বলতে চান না। নাকি মনে পড়ে না! জার্মানি-স্পেনের দর্পচূর্ণ করে নকআউটে ওঠার পরে নইমের চিন্তাভাবনা বদলে দিয়েছে জাপান। দ্রোণাচার্য কোচের প্রশ্ন, ”জাপান যদি পারে তাহলে আমরা পারব না কেন?”
[আরও পড়ুন: বিশ্বকাপে তিন মহিলা রেফারি, রক্ষণশীল কাতারেই তৈরি হল ইতিহাস]
১৯৭০ সালের ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে ভারতের সেই দলে ছিলেন শ্যাম থাপাও। জাপানের (Japan) জয় দেখে বলছেন, ”নইমের কথা মনে পড়ছে। ও তো আমাদের ক্যাপ্টেন ছিল। দিন দুয়েক আগেই নইমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ও হায়দরাবাদে চলে গিয়েছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে একেবারে একা হয়ে গিয়েছে। ওখানে মেয়ের সঙ্গে রয়েছে।”
কুবো, কামাদা, তানাকারা আজ জাপানে নায়ক। বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন। ৫২ বছর আগে জাপানের সেরা ফুটবলার ছিলেন কামামোতো। সেই সময়ে তাঁর যথেষ্ট নাম ডাক ছিল এশিয়ায়। ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে কামামোতোকে বোতলবন্দি করে রেখেছিলেন সুধীর কর্মকার। জনশ্রুতি এমনটাই বলে। নইমের সঙ্গে স্টপারে খেলেছিলেন সুধীর। পুরনো সেই ম্যাচ প্রসঙ্গে সুধীর কর্মকার বলছিলেন, ”আমি তো টিম লিস্ট দেখে অবাকই হয়ে গিয়েছিলাম। প্লেয়ার্স লিস্টে স্টপারের জায়গায় আমার নাম লেখা। সেখানে সি প্রসাদের নাম লেখা ছিল না। প্রদীপদা (পিকে ব্যানার্জি) আমাকে বলে ওঠেন, ওদের কামামোতো আছে। ওকে তুই আটকাবি।” কামামোতো সেদিন নড়তে পারেননি। কীভাবে থামালেন জাপানের নামী তারকাকে? স্মৃতির পাতা উল্টে সুধীর বলছেন, ”ওদের হাফ লাইন যখনই বল ধরছিল আমি কামামোতোর ক্লোজে চলে আসছিলাম। নইমকে বলেছিলাম আমি হেড করতে উঠলে ও যেন পিছনে চলে যায়। আবার নইম হেড করতে উঠলে আমি পিছনে চলে যাচ্ছিলাম। এভাবেই আমরা কামামোতোকে বিপজ্জনক হতে দিইনি।”
সুধীর কর্মকারের খেলা দেখে তদানীন্তন ফিফা প্রেসিডেন্ট স্ট্যানলি রাউস ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। নামী বাঙালি ডিফেন্ডার বলছিলেন, ”১৯৭০ সালের এশিয়ান গেমসের পরে ৫২ বছর হয়ে গিয়েছে অথচ পদক আর এল না ফুটবলে।আমরা এই জাপানকে হারিয়েছিলাম। ওরা এখন বিশ্বকাপ খেলছে। জার্মানি, স্পেনের মতো দেশকে হারাচ্ছে। এশিয়ার ফুটবল এগোচ্ছে, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবধান ক্রমশ কমে আসছে। অথচ আমরা বিশ্বকাপ থেকে বহু দূরে। কেন এমন হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাই না।”
সুধীরের সব কথা মনে থাকলেও নইমের স্মৃতি বিদ্রোহ করে বসে। তিনি বলছেন, ”অনেক আগের কথা। সব মনে পড়ে না। অনেক কিছু ভুলে গিয়েছি এখন। মনে আছে প্র্যাকটিস করতাম। এক ঘণ্টা, দু’ ঘণ্টা, প্র্যাকটিস চলতেই থাকত। জিম ছিল না, সুইমিং পুল নেই, পরিকাঠামো ভাল নয়। ভাবছি আমাদের সময়ে যদি আধুনিক সব ব্যবস্থা থাকত, তাহলে কী হত!”
তখনকার পৃথিবী দেখেনি মোবাইল ফোন, ছিল না ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়া কী বস্তু- কেউ কল্পনাও করতে পারত না। একসময়ে যে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন নইমউদ্দিনরা, তা সহজলভ্য নয় এখনকার প্রজন্মের কাছে। এর জন্য দুঃখ হয় না? নইমউদ্দিন কী বুঝলেন জানা নেই। তিনি বলে চলেন, ”জাপান আজ বিশ্বকাপ খেলছে। ওদেরকে আমরা হারিয়েছিলাম। এটা তো আমাদের কাছে অ্যাচিভমেন্ট।”
সৈয়দ নইমউদ্দিনকে নিয়ে ভারতীয় ফুটবলে কত গল্প। শৃঙ্খলাপরায়ণ কোচের অনুশাসন অনেক সময়ে ফুটবলারদের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াত। ফুটবলারদের কথা নিরন্তর ভাবতেন। কোচিং করানোর সময়ে দুধ, কলা, বাদাম আনার নির্দেশ দিতেন ক্লাবকর্তৃপক্ষকে। প্র্যাকটিস সেরে উঠে ফুটবলাররা খাবেন সেই খাবার। বড় চুল রাখা একদম পছন্দ করতেন না। দীর্ঘ সময় ধরে অনুশীলন করাতেন। তাতেও বিরাগভাজন হয়েছেন অনেকের। কিন্তু ফুটবলারদের জন্য সারা দিনরাত ভাবতেন নইমউদ্দিন। আফশোসের সুরে বলেন, ”আমি এখন ভাবছি পাঁচ-দশ বছর নষ্ট করেছি। চুল বড় রাখলে কী হয় জানেন? শরীরের কত রক্ত নষ্ট হয়। নখ বড় রাখলে নখের নোংরা খাবারের মাধ্যমে পেটে চলে যায়। পেটে কৃমি থাকে। সেই কৃমি মানুষের শরীরের সব পুষ্টিরস খেয়ে নেয়।” কোচিং জীবনে ফুটবলারদের কেন চুল ছাঁটতে বলতেন, নখ কাটতে বলতেন, তার ব্যাখ্যা যেন এই বৃদ্ধ বয়সে দিচ্ছেন নইম। সাদা শার্ট, আকাশি নীং রংয়ের জিনসের প্যান্ট আর চোখে রোদচশমায় তাঁকে দেখে অভ্যস্ত কলকাতা ময়দান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর জোর দিতেন খুব।
একসময়ে শোনা গিয়েছিল নিজের মেডেল বিক্রি করে দেবেন। নইম বলছেন, ”মেডেল বিক্রি করে ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরি করতে চেয়েছিলাম। আমার নিজের কাছে যদি টাকা থাকত, তাহলে তো নিজেই অ্যাকাডেমি তৈরি করতাম। সেই অ্যাকাডেমি থেকে ফুটবলার তৈরি হত। তারা দেশের হয়ে খেলত। দেশের সুনাম হত। আগে তো নিজের ঘর পরিষ্কার রাখুন। চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম।”
ফুটবল ছেড়ে দীর্ঘদিন বানপ্রস্থে নইম। অথচ এখনও তাঁর চিন্তায় চেতনায় ফুটবল আর ফুটবল। জিজ্ঞাসা করছিলেন বিশ্বকাপের কথা।
-ইংল্যান্ডের কী খবর?
-ব্রাজিলকে আগের মতো লাগছে না কিন্তু।
-পর্তুগাল কিন্তু ভাল কিছু করবে।
-আর্জেন্টিনার খেলাও আমাকে টানছে না। তবে মেসি গ্রেট।
পরক্ষণেই চলে যাচ্ছেন নিজের প্রসঙ্গে। বলছেন, ”আমার অবদান কী কম বলুন তো! আমি নিজে ন্যাশনাল টিমের হয়ে খেলেছি। তিনটে ক্লাবকে কোচিং করিয়েছি। জাতীয় দলের কোচ ছিলাম। বাংলাদেশেও কোচিং করিয়েছি।” কথা শেষ করেন না নইম।
স্ত্রীর প্রয়াণ তাঁকে আঘাত করেছে খুব। একদম একা হয়ে গিয়েছেন। নইম বলছেন, ”আমার স্ত্রী চাইত আমি ওয়ার্ল্ডের সেরা কোচ হই। আমাকে সাপোর্ট করে গিয়েছে চিরকাল। আমার মতো আর কারও অবদান রয়েছে বলুন তো।” ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন উড়ে আসছে দেখে নইম বলছেন এই প্রতিবেদককে, ”ইন্টারভিউয়ের জন্য কত টাকা দেবেন? এরপরের বার ইন্টারভিউ নিলে কিন্তু অনেক টাকা দিতে হবে।”
এদেশের ফুটবলে বিদেশি কোচ, বিদেশি প্লেয়ারের অনুপ্রবেশ পীড়া দেয় নইমকে। প্রশ্ন করছেন, ”একজন বিদেশি প্লেয়ার সারা দিনে কত টাকার খাওয়াদাওয়া করেন জানেন? ভাল খাবার না খেলে মাঠে খেলবে কী করে? বিদেশি কোচ আসছে এদেশে। আমাদের সময়ে তো দেশের কোচরাই পদক এনে দিয়েছে।”
নইমের কথা শুনে জলসাঘর ছবির সেই জমিদারের কথা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বম্ভর রায়ের জমিদারি চলে গিয়েছিল। কিন্তু থেকে গিয়েছিল প্রবল আত্মমর্যাদা বোধ। সৈয়দ নইমউদ্দিনও এখন ভারতীয় ফুটবলের মূল স্রোত থেকে বহুদূরে। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল, পুরনো সুখস্মৃতিই তাঁর সম্বল। ভারতীয় ফুটবল একদিন বড় মঞ্চে খেলবে, সাফল্য আনবে এই স্বপ্ন দেখেন দ্রোণাচার্য কোচ।