রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: লর্ডস থেকে লন্ডনের ‘ও-টু’ এরিনার দূরত্ব কত হবে? মেরেকেটে মাইল দশ-বারো! মোটরগাড়িতে ঘণ্টাখানেক লাগা উচিত বড়জোর। তা, শুক্র ও শনি-বিলেতের আপাতত দুই চরম আকর্ষণীয় ক্রীড়া পীঠস্থানে পিঠোপিঠি সময়ে নির্ঘাত বসেছিলেন দুই দেবতা, টেনিস এবং ক্রিকেটের! এবং দুই প্রিয় শিষ্য-শিষ্যার অবসর-পরিকল্পনা নিয়ে শলাপরামর্শও দু’জনে করেছেন নিশ্চয়ই, আলবাত করেছেন, নইলে দুই যুগন্ধরের বিদায়লগ্নে এত আশ্চর্য সব মিল থাকে কী করে?
গত রাতে ‘ও-টু’ এরিনায় লেভার কাপে রজার ফেডেরারের (Roger Federer) আকস্মিক বিদায় ও অবসর দেখে হাহাকার করতে করতে ঘুমোতে গিয়েছিল বাঙালি। দেখেছিল, রজারের সঙ্গে আরও একজনকে কাঁদতে, কেরিয়ারজুড়ে তাঁকে বারবার বিপাকে ফেলা রাফায়েল নাদালকে (Rafael Nadal)! আর শনি-দুপুরে মহালয়ার প্রাকলগ্নে বাঙালি লর্ডসে তার প্রিয় আত্মজের বিদায়বেলায় অতি বিস্ময়ে আবিষ্কার করল, সম্পূর্ণ ভিন্ন একজনকে কাঁদতে। হরমনপ্রীত কউরকে! শনিবার থেকে অবসর পৃথিবীর পাসপোর্ট হাতে নেওয়া ঝুলন গোস্বামীর যিনি সহোদরা-সমই নন, বর্তমান ভারত অধিনায়কও বটে! আরও মিল চান? উদাহরণ চাই আরও? ঠিক আছে। গত রাতে রাজা রজার কোর্ট ছাড়ার সময় উঠে দাঁড়িয়েছিল সমগ্র ‘ও-টু’ এরিনা, সমবেত করতালিতে বর্ষণ করেছিল শ্রদ্ধার গোলাপ।
এদিন ঝুলন গোস্বামী (Jhulan Goswami) মাঠে ব্যাট হাতে ঢোকার সময় একইভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল লর্ডস, আবেগের গানস্যালুট দিতে দিতে। লর্ডস ছাড়ুন,পুরো ইংল্যান্ড টিম পর্যন্ত এদিন ‘গার্ড অফ অনার’ দিয়েছে ঝুলনকে! দু’দশক ধরে শ্রেষ্ঠত্বের রাজদণ্ড সফলভাবে বহন করেছেন যিনি, সেই বঙ্গসন্তানের শেষ দিনে নতজানু হয়েছে কিনা ইংরেজরাও! ভেজা চোখ নিয়ে হরমনপ্রীত আবার টসের সময় আলাদা করে ডেকে নিয়েছেন প্রিয় ‘ঝুলুদি’-কে। টসটাও হরমনপ্রীত করতে দিলেন অগ্রজকেই, বুঝিয়ে আজকের অলিখিত অধিনায়ক তুমিই! আচ্ছা, গত রাতে লেভার কাপে ইউরোপ টিমে রাফা-নোভাক থাকা সত্ত্বেও অদৃশ্য অধিনায়ক রজারই ছিলেন না?
[আরও পড়ুন: অনুশীলন ম্যাচে ভারতের অনূর্ধ্ব-২০ দলকে হারাল ইস্টবেঙ্গল, কলকাতা লিগে নামছে রিজার্ভ দল]
শেষ কবে পরপর দু’দিনে দুই খেলার দুই নক্ষত্র গোটা পৃথিবীর ক্রীড়া-জনতার কণ্ঠস্বর কান্নায় অবরুদ্ধ করে অবসরে চলে গিয়েছেন, মনে পড়ে না। আর ভারতীয়দের কাছে ঝুলনেরটা তো কোথাও গিয়ে আরও বেদনার, আরও হৃদয় শূন্য করা। আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের দর্পণে ঝুলন গোস্বামী তো নিছক এক কিংবদন্তির নাম নয়, এক চলমান প্রভাব। দেশে মহিলা ক্রিকেট জাগরণের বিমূর্ত প্রতীক মিতালি রাজের সঙ্গে ঝুলন না থাকলে টিভি খুলে আজও কত জন ভারতীয় মহিলা টিমের খেলা দেখতে বসতেন, সন্দেহ আছে। আর টেনিসে রজারের পর তবু একটা রাফা আছে, একটা নোভাক আছে। কিন্তু শনিবার ঝুলন অস্তাচলে যাওয়ার পর যে এক মহাকাশ শূন্যতা সৃষ্টি হল, তা পূরণ করবে কে? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শেষ দিনেও অবিশ্বাস্য কৃপণ বোলিং করে দু’টো উইকেট তুলে নিলেন। দশ ওভারে দিলেন মোটে ৩০ রান! এবং বাউন্ডারি রোপের ভেতরের দুনিয়ায় পা রাখার পর ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’-কে দেখে একবারও মনে হয়নি, বিদায়ী আবেগের লেশমাত্র তাঁর মধ্যে আছে বলে। সতীর্থদের কাঁধে চেপে মাঠ ছাড়ার সময় অনর্গল হাসি ছাড়া পাওয়া যায়নি কিছু। অবশ্য এ দিন মাঠে নামার আগে স্কাই স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঝুলন বলেও দিয়েছিলেন, “মাঠে নেমে ওসব আবেগ দেখানো আমার পক্ষে অসম্ভব।”
ঠিকই, অসম্ভব। তা সে যতই তাঁকে ঘিরে বহির্বিশ্বে আবেগস্রোত বয়ে যাক। সিএবি তো এ দিন ইডেনের একটা স্ট্যান্ড ঝুলনের নামে করবে বলে ঘোষণাও করে দিল। কিন্তু বিদায়ী দিনেও ঝুলন অবিচল, নিশ্চল। কী করা যাবে, ক্রিকেট নামক প্রেমের টানে চাকদহ থেকে ট্রেনে করে নিত্য ইডেনে খেলতে আসতে হয়েছে যাঁকে, এককালের পুরুষতান্ত্রিক ক্রিকেট-সমাজের সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে যাঁকে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে হয়েছে, যাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে কখন পাড়ার ছেলেদের ব্যাটিং শেষ হলে তিনি একটু ব্যাটিং পাবেন, যাঁকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয়েছে ‘মেয়ে হয়ে আবার তুমি ক্রিকেট খেলবে কী?’-আবেগ তাঁর বন্ধু হতে পারে না।
আবেগে বশীভূত হলে ঝুলন গোস্বামীকে বহু আগে ভস্মীভূত হয়ে যেতে হত। এক নয়, দুই নয়, জীবনের কুড়িটা বছর লেগে গিয়েছে ঝুলনের কিংবদন্তির তাজ পেতে। আর কুড়ি বছর পর যে গর্বের শৃঙ্গে পৌঁছেছেন ঝুলন, তা দেখে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত গর্বিত ভাবে বলতে পারেন, “ইস, আমার মেয়ে যদি ঝুলন গোস্বামীর মতো ক্রিকেটার হতে চাইত!” এবং ঠিক এখানেই ঝুলনের সঙ্গে ফেডেরারের সবচেয়ে বড় অমিল। ফেডেরার যে খেলাটা খেলতেন, তা তাঁর আগমনের আগেও স্বমহিমায় বিচরণ করত, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু ঝুলন যে খেলাটা খেলতেন, সেই মহিলা ক্রিকেটের অস্তিত্ব সম্পর্কেই অধিকাংশ ভারত জানত না কুড়ি বছর আগে! আর তাই কোথাও গিয়ে মনে হয়, অবসরকালে বঙ্গসন্তানের বিশ্বকাপ-যন্ত্রণা অমূলক, বড় অমূলক। ঝুলন গোস্বামী বিশ্বকাপ পাননি ঠিক। কিন্তু ঝুলন গোস্বামী-ই ভারতকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিলেন!