সৌরভ মাজি, বর্ধমান: কালের নিয়মে অনেক লোক সংস্কৃতি হারিয়ে গিয়েছে। হারাতে বসেছে আরও অনেক। বর্ধমানের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির অঙ্গ ঘুড়ির মেলা। সেটাও কী এবার অবলুপ্তির পথে? মকর সংক্রান্তির আগে তেমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে বর্ধমান শহরের অন্দরে। পৌষ সংক্রান্তির আগের সেই চেনা ছবি ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
সর্বজিৎ যশ। ইতিহাসবিদ। তিনি বর্ধমানের ঘুড়ির মেলার স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন, “এখন আর সেই আকর্ষণ কোথায়। ঘুড়ি উড়তেই দেখা যাচ্ছে না। অন্য সংস্কৃতির মতো এটাও হারাতে বসেছে।”
[আরও পড়ুন: আবাসের তালিকা থেকে এত নাম বাদ কেন? শিলিগুড়িতে নেমেই আধিকারিকদের প্রশ্ন কেন্দ্রীয় দলের]
বর্ষীয়ান তমাল দাস শোনাচ্ছিলের অতীতের কথা। আগে ঘুড়ির মেলার অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। কচিকাঁচা থেকে আধবুড়োরা ব্যস্ত থাকত সুতোয় মাঞ্জা দিতে। খারাপ হয়ে যাওয়া টিউবলাইট, বাল্ব জোগাড় করা। সেগুলো মিহি করে গুঁড়ো করা। বাবলা গাছের আঠা, বা শিরিষ আঠা সংগ্রহ করা। তার পর সুতো কেনা। সেই সুতোয় অ্যারারুট, সাবু-সহ অন্যান্য আঠালো জিনিস দিয়ে লেই বানানো হত। এর পর বড় মাঠে গিয়ে সেই লেইয়ে সুতো ডুবিয়ে কাঁচের গুঁড়োর ভিতর দিয়ে লাটাইয়ে গুটানো হত। মাঞ্জা সুতো তৈরি হল। এবার সেটাকে বিশেষ পদ্ধতিতে শুকানোও হত। কখনও আবার ঘুড়ি উড়িয়ে সেই সুতো শুকনো হত। শীতের দিনে ঘরে ঘরে এটা চালু ছিল। এখন সেই দৃশ্য এখন চোখেই পড়ে না। ডিসেম্বর থেকেই ঘুড়ি ওড়ানো হত শহরে। কত রকমের নাম, পেটকাটি, চাঁদিয়াল, বগ্গা, তেরঙ্গা, তিলকওয়ালি, বলওয়ালি। এখন মনেও করতে পারছেন না সব নাম। সেই সব দিন উধাও হয়ে গিয়েছে। এখন আকাশে ঘুড়িই আর চোখে পড়ে না।
ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন, অন্যত্র বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়িল মেলা হয়। বর্ধমানে অবশ্য সেদিন হয় না।বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদের আমলে পৌষ সংক্রান্তির দিন ঘুড়ির মেলার প্রচলন হয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর কথা। তখন তিনদিন ধরে শহরের তিন প্রান্তে ঘুড়ির মেলা হত। শহরের প্রাণকেন্দ্রে পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ির মেলা হত। পরদিন, অর্থাৎ পয়লা মাঘ হত সদরঘাটের ঘুড়ির মেলা। তার পর দিন হত শহরের বাহির সর্বমঙ্গলাপাড়ার ঘুড়ির মেলা। রীতিমত উৎসব। সর্বজিৎবাবু বলেন, “শীতের সময় আকাশে ঘুড়ির সমাহার অবাক করার মতো ছিল। কত ধরনের, কত রঙের ঘুড়ি উড়তো। আকাশ ভরে থাকত। মাঝেমাঝেই ভোকাট্টা আওয়াজ বুঝিয়ে দিত ঘুড়ির লড়াইয়ে কেউ জিতল।” গত কয়েকবছরে সেই উৎসবে ভাটা।
[আরও পড়ুন: ‘দিলীপ ঘোষকে ভালবাসি’, ঝরঝরে বাংলায় বললেন শত্রুঘ্ন সিনহা! কেন জানেন?]
ঘুড়ির মেলাকে কেন্দ্র করে এই শীতে বিশাল অঙ্কের লেনদেনও হতো বাজারে। নাসির খান নামে এক ঘুড়ি ব্যবসায়ী বলেন, “বছর দশেক আগেও ঘুড়ির মেলার একমাস আগে থেকেই ব্যাপক বিক্রিবাটা হত। এখন তার সিকিভাগও হয় না। এখন ঘুড়ির মেলার আগের দিন যেটুকু বিক্রি হচ্ছে।” কেন হারিয়ে যাচ্ছে এই সংস্কৃতি? সর্বজিৎবাবুর কথায়, “এখনকার ছেলেমেয়েদের ঘুড়ি ওড়ানোর মত সময় নেই, মানসিকতাও নেই। অন্য দিকে ঝোঁক তাদের। আবার ঘুড়ি, সুতো, লাটাই সবেরই দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়াটাও একটা কারণ বলে মনে হয়।”