কেউ তালাবন্ধ হাজত থেকে বেরিয়ে এসেছেন অবলীলায়। অন্যের রোগ টেনে এনেছেন নিজের শরীরে। কেউ নিমেষে তালুবন্দি করেছেন কাঙ্খিত বস্তু। কেউ আবার একই সময়ে একাধিক জায়গায় থেকেছেন। বুদ্ধিতে এসবের ব্যাখ্যা মেলে না। অথচ বুজরুকি বললে ইতিহাসকে অপমান করা হয়। অণিমা, লঘিমা, গরিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, মহিমা, ঈশিতা, বশিতা। অষ্টসিদ্ধি করায়ত্ত করা সাধকদের খুঁজেছেন গৌতম ব্রহ্ম। আজ তৃতীয় পর্ব।
এক লহমায় ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল মহাপুরুষের সব শিক্ষা। দুই দিকে ঝকমক করছে খেলা তরবারির সারি। যুদ্ধের মেজাজে দুই শিবির। এই মারে তো সেই মারে। হিন্দুদের দাবি, অগ্নিসংস্কার করা হবে কবীরের পূত দেহ। অন্যদিকে মুসলমানরা কোমর বেঁধেছে কবর দিতে। জীবনভর যে মানুষটা জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেলেন, তিনি চোখ বুঝতেই ভয়ংকর অবস্থা। তাঁর অনুগামীদের মধ্যেই সম্মুখ সমর! সামনে কুলকুল করে বয়ে চলেছে মগহরের অমী নদী। নদী পাড়ে একটি পরিত্যক্ত কুঠির। তাতেই শায়িত কবীরের মরদেহ।
বারাণসী থেকে একটু আগেই পদব্রজে এখানে এসেছিলেন কবীর। পিছু পিছু একঝাঁক ঘনিষ্ঠ অনুগামী। তাঁদের শেষ বিদায় জানিয়ে শয্যা নিলেন মহা সন্ত। ধবধবে সাদা কাপড়ে সাধককে ঢেকে দিলেন রাজ সেনাপতি বিজলী খাঁ। তারপর কবীরের নির্দেশমতো সবাই কুঠিরের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। শুরু হয়েছে অপেক্ষা। কে জানত এই পর্বেই শুরু হবে সাধকের অন্তেষ্টি নিয়ে তুমুল ঝামেলা! পরিস্থিতি ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। গোরখপুরের অমী নদীর পাশে পেশী ফোলাচ্ছে দু’পক্ষ। হঠাৎ কবীরের পরম মিত্র নন্দু চিৎকার করে উঠলেন, “আপনারা থামুন। চলুন কুটিরের ভিতর।”
[আরও পড়ুন: তালাবন্ধ হাজত থেকে বেরিয়ে এলেন নগ্ন সন্ন্যাসী, পড়ুন সাধকের অলৌকিক শক্তির কাহিনি]
কিন্তু মরদেহ পথ দেখাবে কী করে?
সবাই কুটিরে ঢুকলেন। শায়িত সাধকের দেহ সাদা কাপড়ে ঢাকা। চিন্তায় আকুল নন্দু। বিবাদ মীমাংসার জন্য প্রাণপণে স্মরণ করছেন কবীরকেই। সাদা কাপড় সরাতেই বিস্ময়ে অভিভূত সবাই। মরদেহ উধাও! তার জায়গায় ফুলের স্তূপ, পদ্মের পাপড়ি। সুগন্ধে মঁ মঁ করছে চারদিক। দু’পক্ষই সেই ফুল নিয়ে চলে গেল। সাহিত্যিক-সাংবাদিক শংকরনাথ রায়ের ‘ভারতের সাধক’ গ্রন্থে এমনই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
ঘটনার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও কেউ এ পর্যন্ত কবীরের অন্ত্যেষ্টি নিয়ে আলোকপাত করতে পারেননি। বরং বারাণসীর কবীর বিশেষজ্ঞদের একাংশ এই ‘কাহিনী’কেই মান্যতা দিয়েছেন। তাঁদের মত, সন্ত কবীরের নশ্বর দেহকে অদৃশ্য করে প্রতিভাত হয়েছিল যে ফলের স্তবক, বারাণসীর হিন্দুদের তৈরি কবীরচৌরার সমাধিমন্দিরে তার অর্ধেক সংরক্ষিত রয়েছে। বাকিটা ঠাঁই পেয়েছে মগহরে মুসলিমদের তৈরি কবীর মাজারে। কবীরপন্থীদের কাছে দু’টিই তীর্থস্থান।
ভক্ত কবীরের জীবনগাথার ছত্রে ছত্রে এমন অনেক অলৌকিক ঘটনা। ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধাকে নিয়ে একাধিক শর্ট ফিল্ম, চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, কবীরের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিম দু’পক্ষই সুলতানের কাছে নালিশ জানিয়েছে। দিনের আলোয় মশাল জ্বালিয়ে এসেছেন দুই ধর্মের স্বঘোষিত গুরুরা। বলছেন, কবীরের বেলেল্লপনার জন্যই নাকি অকাল অন্ধকার নেমে এসেছে সমাজ জীবনে। তাঁদের ধনুকভাঙা পণ, কবীর দুই ধর্মেরই বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। নতুন ধর্মের প্রচলন করতে চাইছে। কবীরের উসকানিতেই সবাই নিজের ধর্মের প্রতি অনাস্থা জানাতে শুরু করেছে।। প্রচলিত ধ্যান-ধারণা সরিয়ে কবীরপন্থী হয়ে উঠেছে সবাই। অতএব, কবীরকে কঠিন শাস্তি দিতে হবে।
[আরও পড়ুন: সন্ন্যাসীর দুই কান দিয়ে বেরিয়ে আসে চুন ও আফিম, পড়ুন সাধকের অলৌকিক শক্তির কাহিনি]
ঠিক যেন যিশুখ্রিস্টের বিরুদ্ধে স্বার্থান্বেষীদের জেহাদ!
সব শুনে সুলতান রেগে আগুন। কবীরের প্রাণদণ্ড হল। প্রথমে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত। তারপর জলে ফেলে মারার চেষ্টা। কাজ না হওয়ায় খুঁটিতে বেঁধে আগুনে পোড়াতেও কসুর করা হয়নি। কিন্তু বেঁচে যান আচার্য রামানন্দের শিষ্য। নিভে যায় আগুন। উলটে সুলতান ও তাঁর প্রধান সাগরেদের শরীরে শুরু হয় অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা। একেবারে প্রাণ যাওয়ার উপক্রম। শেষে শাস্তিদাতারাই শরণ নেন কবীরের। জীবনভিক্ষা চান। দু’জনকেই নিঃশর্ত ক্ষমা করে কবীর বলেছিলেন, “অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।”
এমন অনেক ঘটঘনার কথা মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে কবীরের জীবনীতে। কথিত আছে, বিধবা ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন কবীর। পালক মা নীমা ও পিতা নিরু দুধের শিশুকে একটি সরোবরের পদ্মপাতার উপর কাঁদতে দেখে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। স্ত্রী লোয়ির সম্মান বাঁচাতে গিয়েও কবীরের সিদ্ধাইয়ের মহিমা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে মরদেহ পুস্পিত হওয়ার কথা।
The post কবীরের দেহ উধাও, সাদা থানের নিচে ফুলের স্তূপ, পড়ুন সাধকের অলৌকিক শক্তির কাহিনি appeared first on Sangbad Pratidin.