সৌরাশিস লাহিড়ি: বিরাট কোহলি ওয়ান ডে-তে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হয়েই গিয়েছে? না, খুব তাড়াতাড়ি সেটা হওয়ার পথে? সেঞ্চুরিয়নে ওর ৩৫-তম ওয়ান ডে সেঞ্চুরি দেখতে দেখতে আমার ঠিক এটাই মনে হচ্ছিল। কেমন যেন মনে হয়, বিরাট এখন ঘুম থেকে উঠে ঠিক করে ফেলে আজ কত বলে সেঞ্চুরি করবে। ‘চেজ’ করে আজ সেঞ্চুরি ইনিংসটা কীভাবে খেলবে! রান তাড়া করে সেঞ্চুরি করার ব্যাপারে বিরাটকে এখনই নির্দ্ধিধায় সর্বকালের সেরা লিখে দেওয়া যায়। ব্যাটিংটাকে যে স্ট্যান্ডার্ডে তুলে নিয়ে গিয়েছে বিরাট, তাতে এখন যেন ও প্রত্যেক বোলারের প্রতিটা ওভারকে আলাদা আলাদা স্টাইলে খেলতে পারে। আউটস্ট্যান্ডিং ব্যাটিং বললেও কিছুই বলা হয় না। আসলে বিরাটের ব্যাটিংয়ের প্রশংসা করতে করতে বিশেষজ্ঞদের ভাষা-ই ফুরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে।
[‘অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উন্নত অবতারই বিরাট’]
শুক্রবার মর্নি মর্কেল-এনগিডি-ইমরান তাহিরদের জাস্ট ছেলেখেলা করে ৮২ বলে সেঞ্চুরি (শেষ পর্যন্ত ৯৬ বলে ১২৯ নটআউট, ১৯X৪, ২X৬) করল কোহলি। এই সিরিজে তিন নম্বর সেঞ্চুরি। শেষ ১০ ওয়ান ডে-তে পাঁচটা সেঞ্চুরি। অতিমানবীয় পারফরম্যান্স! যার সুবাদে এদিন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১৮ ওভার বাকি থাকতে ভারতের আট উইকেটে হাসতে হাসতে জেতাটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি টার্গেটের ৬৩ পার্সেন্টে রান একাই করে, তার দল হাসতে হাসতে জিতবে না তো কী?
ম্যাচের শুরুতে টিভিতে একটা স্ট্যাটস দেখছিলাম। সেঞ্চুরিয়নে শেষ পাঁচটা ওয়ান ডে—তে প্রথমে ব্যাট করা দলের অ্যাভারেজ স্কোর ৩৩২। তা সত্ত্বেও প্রথমে ব্যাট করা দল তিন বার জিতেছে। পরে ব্যাট করা দল জিতেছে দু’বার। সোজা কথা, এখানকার পিচে প্রচুর রান ওঠে। সেখানে টস জিতে বিরাটকে ফিল্ডিং নিতে দেখে একটু অবাকই লাগল। পরক্ষণে ওর অন গ্রাউন্ড ইন্টারভিউ শুনে মনে হল, ইয়েস এই হল একটা টিমের ক্যাপ্টেন! মনে হল, বিরাট কোহলি আজ যা ভাবে, গোটা ভারতীয় ক্রিকেট সেটা কাল ভাববে।
[এবার প্রিয়ায় চোখের চাহনিতে ঘায়েল দক্ষিণ আফ্রিকার এই ক্রিকেটার]
কেন? দেখুন ভারত বিরাট ইতিহাস দক্ষিণ আফ্রিকায় আগের ওয়ান ডে-তেই গড়ে ফেলেছে। হ্যাঁ, শেষ ম্যাচ জিতে সিরিজ ৫-১ করে আরও অসাধারণ কীর্তি হল। কিন্তু তার চেয়েও কোহলির কাছে এই ম্যাচ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতিতে ওর টিম কীরকম করতে পারে সেটা আগাম বুঝে নেওয়া। মাঠে হাতে-কলমে দেখে নেওয়া। এটাই হল যে কোনও টিম স্পোর্টে একজন সত্যিকারের লিডারের ভাবনা। বর্তমানের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা!
বিরাটের ভারতের এরপর ইংল্যান্ড ট্যুর আছে। এ বছরই অস্ট্রেলিয়া সফরে যাবে। যে দু’টো দেশের কোথাও ব্যাটসম্যান হিসেবে ওর নিজের পারফরম্যান্স ভাল নয়। কোনও দেশে আবার ইন্ডিয়া টিমের রেজাল্ট খারাপ। দক্ষিণ আফ্রিকায় তো এবার প্রথম দু’টো টেস্টের পর থেকে এখনও পর্যন্ত বিরাটরা যেমনটা চাইছে তেমনই খেলা হচ্ছে। জো’বার্গে শেষ টেস্ট জেতার পর ভারত ঐতিহাসিক ওয়ান ডে সিরিজ জিতে নিয়েছে। কিন্তু ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে ছবিটা যে পাল্টে যাবে না কে বলতে পারে? এবং তার জন্য এখন থেকেই বিরাট ভাবনা-চিন্তা শুরু করে দিয়েছে মনে হচ্ছে আমার। সেঞ্চুরিয়নের মতো পিচে টস জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্তটা হয়তো সে কারণেই।
[এভাবেও আউট হওয়া যায়! এ কী করলেন কিউয়ি ব্যাটসম্যান]
প্রথম কারণ, ব্যাটিং পিচে নিজের বোলারদের চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়ে দেখে নেওয়া যে, ওরা ভবিষ্যতে যখন সত্যিকারের এরকম পরিস্থিতিতে পড়বে সেটাকে কীভাবে হ্যান্ডেল করে! কারণ নম্বর দুই, নিজের দলের ব্যাটিং লাইন আপকেও পরখ করে নেওয়া যে, যদি বিরাট টার্গেট তাড়া করতে হয় সেক্ষেত্রে তারা কোন স্ট্র্যাটেজি নেয় ক্রিজে গিয়ে! এমন তো হতেই পারে যে, বিরাট-সহ টপ অর্ডার ফেল করল (যেটা এই সিরিজে বলতে গেলে হয়ইনি), তখন রাহানে-শ্রেয়স-হার্দিকের মিডল অর্ডার কীভাবে সামলায়! আসলে প্লেয়ারের কাছে নিয়মরক্ষার ম্যাচ বলে কিছু হয় না। সেরকম ম্যাচকেও সেই প্লেয়ার নিজস্ব ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে। বিরাটের টস জেতার পর সেঞ্চুরিয়নে আগে ফিল্ডিং নেওয়ার সিদ্ধান্তটা সেরকমই একটা ব্যাপার।
আর বিরাটের দল এদিন আরও একবার খেলার মাঠের সেই পুরনো প্রবচনকে প্রমাণিত করল। একটা দল কতটা শক্তিশালী সেটা বোঝা যায় টিমটার বেঞ্চ-স্ট্রেংথ দেখে। শুক্রবার ভারতের সেরা বোলার শার্দুল ঠাকুর তো রিজার্ভ বেঞ্চের পেসার। ভুবনেশ্বর, বুমরা, সামি, ইশান্ত। সবার পরে আসবে। কিন্তু এদিন ভুবিকে বিশ্রাম দিয়ে যেই শার্দুলকে প্রথম দলে ডাকা হল, তক্ষুনি পারফর্ম করল। কতটা ফিট আর প্র্যাকটিসের মধ্যে থাকলে কোনও রিজার্ভ পেসারের পক্ষে এরকম ভাল বোলিং সম্ভব, নিজে একটু-আধটু ক্রিকেটটা খেলেছি বলে আরও বুঝতে পারছি। তার চেয়েও বড় কথা, ক্যাপ্টেনের ‘চ্যালেঞ্জে’ সাড়া দিয়ে গোটা ভারতীয় বোলিং ইউনিট-ই ভাল করল। যে ভেনুতে শেষ পাঁচ ওয়ান ডে-তে আগে ব্যাট করা টিমের গড় রান ৩৩২, সেখানে এবি ডে’ভিলিয়ার্সদের ২০৪ রানে অলআউট করে দিল চাহালরা।
আর চাহাল-কুলদীপ স্পিনার জুটির সামনে এদিনও দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটিংয়ের দশা? একটা উদাহরণই বোধহয় যথেষ্ট। এবি-র মতো বিরাট ব্যাটসম্যান চাহালের একটু স্পিডে করা ফ্লিপারের সামনে অসহায় বোল্ড! চাহাল ওর লেগস্পিনগুলো সাধারণত ৭০ কিমির মধ্যে করে থাকে। এবি-কে করা ফ্লিপারটা ছিল জাস্ট একটু বেশি গতির। ৮৬ কিমিতে। তাতেই পুরোপুরি ঠকে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার এক নম্বর ব্যাটসম্যান। একটা দলের মানসিকতা আর টেকনিক্যাল দক্ষতা কতটা তলানিতে থাকলে এরকম করুণ দশা হয় পাঠকই ভাবুন!
The post প্রোটিয়াদের হেলায় হারিয়ে সিরিজ ভারতের, রান তাড়ায় সর্বকালের সেরা বিরাট appeared first on Sangbad Pratidin.