অনির্বাণ চৌধুরী: কে জাগে রাত?
‘’নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী/তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।‘’
আজ তিনি আসবেন। বৈকুণ্ঠ ছেড়ে, স্বামীটিকেও ছেড়ে। এই একটি রাত শুধু তাঁর আর ভক্তদের। তাই শারদ পূর্ণিমার রাতে যখন চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হবে চরাচর, তিনিও পা রাখবেন পৃথিবীর মাটিতে। সেই চরণরেখার সূত্রেই বিত্তশালী হবে পৃথিবী!
কিন্তু, সম্পদ কী আর সবাইকে দেওয়া যায়! দেওয়া যায় তাকেই, যে সচ্চরিত্র! যে সেই সম্পদ ব্যয় করবে জগতের কল্যাণে! অতএব, প্রতি কোজাগরী রাতেই শুরু হয় লক্ষ্মীর পরীক্ষা। ‘কঃ জাগর’- বলতে বলতে ধরিত্রী পরিক্রমা করেন দেবী। প্রতিশ্রুতি দেন, যে এই মহীতলে নারকেলের জল পান করে জেগে আছে, যে অক্ষক্রীড়ায় অতিবাহিত করছে রাত, তাকেই সব বিত্ত দেবেন তিনি।
শারদ পূর্ণিমার রাতটি তাই আমাদের জেগে থাকার কথা! লক্ষ্মী কখন আসবেন ঘরে, সেই প্রতীক্ষাতে। কিন্তু তার আগে রয়েছে একটি পূজাপর্ব। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। কেউ বলেন, এই শরতেই ধান পাকে মাঠে। তাই এই কোজাগরী পূর্ণিমার রাতটিতে জেগে থেকে সেই শস্য পাহারা দেওয়া, সঙ্গে আশীর্বাদ চেয়ে নেওয়া শস্যের দেবীরও! কেউ বা আরও একটু এগিয়ে চোখ রাখেন সমাসের আর্থিক চালচিত্রে। বলেন, দুর্গাপূজাতে ব্যয় হয়েছে বহু অর্থ! অতএব, বছরের বাকি দিনগুলো যাতে ভাঁড়ারে টান না পড়ে, সেই জন্যই ধনদেবীর আরাধনা।
কারণ যাই হোক, এই রাতই লক্ষ্মীপূজার প্রকৃষ্ট তিথি। আমরা আবাহন করব দেবীকে। করজোড়ে প্রার্থনা করব, তিনি যেন চঞ্চলা থেকে অচলা হয়ে অবস্থান করেন ঘরে। কিন্তু, তারও রয়েছে এক অলঙ্ঘনীয় নিয়মবিধি। যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন লক্ষ্মী স্বয়ং!
তবে, যে কোনও পূজার আগেই দেবতার স্বরূপটি একটু বুঝে নেওয়া ভাল! শাস্ত্রই তার নির্দেশ দিয়েছে। দেবতাটি না বুঝলে যে তাঁর আরাধনাই বৃথা! তা, লক্ষ্মী দেবীর স্বরূপটি খুঁজতে বেরোলে কী দেখব আমরা?
দেখব, ‘’যজ্ঞবিদ্যা মহাবিদ্যা গুহ্যবিদ্যা চ শোভনা/আত্ম্যবিদ্যা চ দেবি বিমুক্তিফলদায়িনী।‘’ অর্থাৎ অগ্নি পুরাণ মতে শ্রী বা লক্ষ্মী হলেন যজ্ঞবিদ্যা, তিনিই আত্ম্যবিদ্যা, যাবতীয় গুহ্যবিদ্যা এবং মহাবিদ্যাও তিনি। এই সকল বিদ্যা আত্মস্থ করতে পারলেই সম্পদ লাভ সম্ভব। তার সঙ্গে প্রয়োজন শুদ্ধ চরিত্র। না হলে লক্ষ্মীলাভ সম্ভব নয়। কেন না, যিনি শুদ্ধ চরিত্রের নন, তাঁকেই তো বলা হয় লক্ষ্মীছাড়া!
তাই শুদ্ধ চরিত্রে, শুদ্ধ মনে এবং শুদ্ধ শরীরে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন বিধেয়। এই দেবী অল্পেই সন্তুষ্টা। তাই লক্ষ্মীপূজা মোটের উপর বাহুল্যহীন। এমনকী, সব সময় দেবীর মূর্তি স্থাপনেরও প্রয়োজন পড়ে না। কেউ পূজা করেন সরা বা ঘট বা ঝাঁপিতে। কিন্তু, পূজার স্থানটি খুব ভাল করে পরিষ্কার না করলেই নয়। পরিষ্কার করেই ধূপ এবং দীপ জ্বালানো নিয়ম। আর কিছু নয়, তাতে ঘরটি শুদ্ধ হয়, আলোকিত হয়। সেই সঙ্গে শান্ত হয়ে আসে মনটিও। এর পরেই আলপনা আঁকার পালা। যে যাঁর সাধ্যমতো আলপনা আঁকতে পারেন, তবে পূজা স্থানে এবং বাড়ির দরজার কাছে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন না আঁকলেই নয়। বিশেষ করে একটি লক্ষ্মীর পা আঁকতেই হবে পূজার ঘটের পাশে। তার পর?
এর পর মনঃসংযোগের পালা। লক্ষ্মীপূজার সময় কারও সঙ্গে কথা বলতে নেই। অন্যমনস্ক হতে নেই। মনটি স্থির রাখতে হয় লক্ষ্মীতেই। আর যদি দৈবাৎ মনটি অন্যমনস্ক হয়ে যায় বা কারও সঙ্গে বিনিময় হয়ে যায় কিছু কথা? সেক্ষেত্রে যথাবিহিত মন্ত্রপাঠে পূজা কর্তব্য। কেন না, মন্ত্র পাঠ করতে হলে আর অন্যমনস্ক হওয়া বা কথোপকথনের সুযোগ থাকবে না।
এবার পূজা শুরুর পালা। সবার প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করা বাঞ্ছনীয়। তাতে শরীর শুদ্ধ হবে। এর পর জল দিতে হয় সূর্যকে। কেন না, তিনিই সকল প্রাণশক্তির উৎস। এমনকী, সূর্যালোক ছাড়া শস্যও উৎপন্ন হবে না! তাই আসনের সামনে রাখতে হবে একটি তামার পাত্র। সেই পাত্রে জল দিতে হবে সূর্যকে স্মরণ করে। এর পর সামান্য একটু জল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে নিতে হবে পূজার সামগ্রী।
এবার লক্ষ্মীর সামনে একটু ধান আর মাটি ছড়িয়ে সেখানে ঘট স্থাপন করতে হবে। ঘটের গায়ে তেল-সিঁদুর দিয়ে আঁকতে হবে স্বস্তিকচিহ্ন। ঘটে স্থাপন করতে হবে বিজোড় সংখ্যার আমপাতার গুচ্ছ। তার উপরে একটি ফুল-সহ রাখতে হবে একটি কলা বা হরীতকী। এবার দেবীকে প্রণাম করতে হবে এই ধ্যানমন্ত্রে- ‘’ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ/পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্/গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্/রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।‘’ মানে, দক্ষিণহস্তে পাশ, অক্ষমালা এবং বামহস্তে পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, পদ্মাসনে উপবিষ্টা, শ্রীরূপা, ত্রিলোকমাতা, গৌরবর্ণা, সুন্দরী, সর্বালঙ্কারভূষিতা, ব্যগ্রহস্তে স্বর্ণপদ্মধারিণী এবং দক্ষিণহস্তে বরদাত্রী দেবীকে ধ্যান করি। তবে যাঁরা সংস্কৃত মন্ত্র জানেন না, তাঁরা মন্ত্র ছাড়াই পূজা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে হাত জোড় করে, চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করবেন মা লক্ষ্মীর কথা।
এর পর দেবীকে গৃহে আবাহনের পালা। বলতে হবে, ‘’ওঁ লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ ইহ সন্নিধেহি ইহ সন্নিরুদ্ধস্য অত্রাধিষ্ঠান কুরু মম পূজান গৃহাণ।‘’ নইলে হাত জোড় করে বলা- এসো মা লক্ষ্মী, আমার গৃহে অধিষ্ঠান করো, যতক্ষণ তোমার পূজা সমাপন না হয়, স্থির হয়ে থাকো আমার গৃহে। এর পর মনে মনে ভাবতে হবে, স্বয়ং দেবী আপনার দেওয়া নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। যাকে কি না বলা হয় মানসপূজা।
অতঃপর পূজার সামগ্রী একে একে নিবেদন করতে হবে দেবীকে। তিনি গৃহে এসেছেন, তাই একটু জল দিতে হবে ঘটের পাশে আঁকা পদচিহ্নের উপরে। মানে, আপনি দেবীর পা ধুইয়ে দিলেন। এর পর একটু দূর্বা ও আতপ চা দিতে হবে ঘটে, দিতে হবে একটি ফুল। এবং, দেবীর প্রতিমায় বা সরায় বা ঝাঁপিতে দিতে হবে চন্দনের ফোঁটা। তার পর প্রথমে ধূপ ও পরে দীপ নিবেদন। নৈবেদ্য নিবেদন শেষ করে পুষ্পাঞ্জলি। ‘’এষ সচন্দনপুষ্পাঞ্জলি ওঁ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ’’ বলে তিন বার পুষ্পাঞ্জলি দিতে হবে। পুষ্পাঞ্জলি শেষ হলে নারায়ণের উদ্দেশে দিতে হবে একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা। ইন্দ্র আর কুবেরের উদ্দেশে ঘটে দিতে হবে দুটি ফুল। একটি ফুল দিতে হবে মায়ের বাহন পেঁচাটিকেও। সবার শেষে দেবীকে প্রণাম করতে হবে এই মন্ত্রে- ‘’ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে/সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমঽস্তু তে।‘’ তার পর পাঠ করতে হবে লক্ষ্মীর পাঁচালী।
কিন্তু, কয়েকটি কথা খেয়াল না রাখলেই নয়! লক্ষ্মীপূজায় কাঁসর-ঘণ্টা বাজাতে নেই! উচ্চকিত শব্দে বিরক্ত হন দেবী। দিতে নেই তুলসীপাতাও। কেন না, তুলসী দেবী লক্ষ্মীর সতীন! আর ব্যবহার করতে নেই লোহার কোনও বাসন। কেন না, লোহা দেওয়া হয় অলক্ষ্মীকে। তাই লোহা দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে ভক্তের গৃহ ত্যাগ করেন লক্ষ্মী।
মোটের উপর, ভক্তের কাছ থেকে ভক্তি ছাড়া আর কিছুই প্রার্থনা করেন না লক্ষ্মী। তাই একমাত্র তাঁর পূজাই মন্ত্র ছাড়া, শুধু তাঁকে স্মরণ করেই সম্ভব। সেটা মাথায় রেখেই না হয় আমরা পালন করি এই কোজাগরী পূজা! বাজারে সব কিছুই অগ্নিমূল্য? তাতে কী! দেবী তো ষোড়শোপচারে পূজা চাইছেন না! তাঁর অধিষ্ঠানের জন্য হৃদকমলটি বিকশিত হলেই তো হল!
তাতেই লক্ষ্মী আসবেন ঘরে ঘরে!
The post কোজাগরী পূর্ণিমা: লক্ষ্মীপূজার সহজ বিধি appeared first on Sangbad Pratidin.