রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: বছর আট-দশ আগে আইপিএলের (IPL) পুরাকালে ইডেনে নির্দিষ্ট এই ম্যাচটার একটা স্বতঃস্ফূর্ত আকর্ষণ ছিল। আসলে ইডেনে কেকেআর (Kolkata Knight Riders) বনাম পাঞ্জাব-শুধুই ক্রিকেটীয় যুদ্ধের পরিধিতে সীমাবদ্ধ ছিল না কখনও। সে সময় মাঠে যেমন ক্রিকেটীয় সংঘর্ষের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হত গৌতম গম্ভীর-বীরেন্দ্র শেহবাগদের নিয়ে, মাঠের বাইরে আবেগের অসিযুদ্ধ চলত আবার ‘বীর-জারা’-র মধ্যে! ইডেনের ‘বি’ ব্লকে হাজারবাতির ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দিতেন একা শাহরুখ খান একা-ওরফে বীর। আর ‘জারা’, প্রীতি জিন্টাকে দেখা যেত আগুন রঙা লাল জার্সি পরে পাঞ্জাব (Punjab Kings) পতাকা ওড়াতে। ‘রিল লাইফে’র মতো ‘রিয়েল লাইফ’ রসায়ন যাঁদের ছিল বড় নয়নমোহিনী, দর্শনীয়!
কালের নিয়মে সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। সেই কেকেআরও নেই, সেই পাঞ্জাবও নেই। শোনা গেল, পাঞ্জাব মালিক প্রীতি জিন্টা টিমের সঙ্গে প্রায় সমস্ত ম্যাচেই ট্র্যাভেল করছেন। সোমবারের ইডেনে তাঁর উপস্থিত থাকার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তিনি শাহরুখ খান, আসছেন নাকি? নিশ্চিত করে বলার জায়গা নেই। ‘পাঠান’ নাকি এই মুহূর্তে ‘জওয়ান’-এর প্রোমোশন নিয়ে বড়ই ব্যস্ত। আর ব্যস্তসমস্ত হয়ে এলেও যে মাঝরাত্তিরে খেলা শেষে ‘বাদশা’ হাসিমুখে ফিরে যাবেন, গ্যারান্টি কোথায়? সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে বরুণ চক্রবর্তীর মায়া-বোলিংয়ের সামনে যতই নতজানু হোক হায়দরাবাদ, নাইটদের সানরাইজার্স ম্যাচের পূর্ববর্তী যা সমীকরণ ছিল, আজও অবিকল তাই। বিন্দুমাত্র পদস্খলনেরও ক্ষমা নেই আর, আর একটা হারলেই এবারের মতো সলিল সমাধি। বিদায়!
কেকেআর কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত জনান্তিকে শোনা গেল, কারও কারও কাছে নাকি বেশ আক্ষেপ করেছেন টিমের খেলা নিয়ে। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের দুঁদে কোচ চন্দ্রকান্তের এটাই প্রথম আইপিএল অ্যাসাইনমেন্ট। আর এটা ঘটনা যে, ব্যর্থতা শব্দটা কোচ চন্দ্রকান্তের জীবনে বিশেষ আসেনি। মুম্বই, বিদর্ভ, মধ্যপ্রদেশ-তিনটে আলাদা আলাদা টিমকে রনজি চ্যাম্পিয়ন করেছেন নাইট কোচ। কিন্তু স্মরণকালে এই প্রথম সম্ভবত কেকেআর কোচ এমন ভয়ঙ্কর গিরিখাদের মুখোমুখি। শোনা গেল, চন্দ্রকান্ত নাকি দুঃখ করেছেন যে দশটা ম্যাচ পরেও টিমটা ‘টিম’ হিসেবে খেলতে পারছে না বলে। একজন বা দু’জন তেড়েফুঁড়ে খেলে দিচ্ছেন, কিন্তু সমষ্টি হিসেবে নিজেদের পেশ করতে পারছে না টিমটা। বহুবার টিমকে তিনি নাকি বলেওছেন সেটা। বলেছেন যে, সবাই ছোট-ছোট অবদান রাখো। টিমের বৃহত্তর স্বার্থে যা কাজে লাগবে।
[আরও পড়ুন: জামা মসজিদ নাকি নীলকণ্ঠ মহাদেবের মন্দির? দ্বন্দ্ব ঘোচাতে সমীক্ষায় রাজি ASI]
ইডেন পিচের যা পূর্বাভাস পাওয়া গেল, তাতে ‘পণ্ডিতমশাই’-এর টেনশন একটু কমা উচিত। ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় পিচ-মাঠ গত তিন দিন ধরে সবই ঢেকে রাখছেন ইডেন কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়। যার নিটফল–পিচে জল দেওয়া যায়নি। অর্থাৎ, ইডেনে আগের সমস্ত ম্যাচের চেয়ে পাঞ্জাব ম্যাচে বল বেশি ঘুরবে। কিন্তু তাতে লাভ হবে তো? বরুণ দারুণ বল করছেন, ঘূর্ণির ফায়দা সুদে-আসলে তুলবেন ঘূর্ণি-ঝড় সৃষ্টি করে। সুহাস শর্মা–তাঁরও মন্দ করা উচিত নয়। কিন্তু বিগত দশ-বারো বছর ধরে যিনি নাইট-স্পিনের মধ্যমণি, সেই সুনীল নারিন? কী করবেন তিনি? আইপিএল স্ট্যাটস বলছে, চলতি টুর্নামেন্টে দশটা ম্যাচ খেলে নারিন রান দিয়েছেন প্রায় তিনশো। উইকেট সাতটা। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর–নারিন দেখলে বিপক্ষ ছাউনিতে যে দমবন্ধ আতঙ্কটা চেপে বসত, সেটাই আর এবার নেই! অভিজ্ঞতা বিচারে আইপিএলের ‘ছোকরা’-রাও তাঁকে এখন অবলীলায় মাঠের বাইরে ফেলে দিচ্ছেন! এ দিন ইডেনে ট্রেনিংয়ের ছবিও মোটে ভরসাযোগ্য নয়। নীতীশ রানা তাঁকে বেশ কয়েক বার স্টেপ আউট করে ফেলে দিলেন। পাঞ্জাবের ব্যাটিং কোচ ওয়াসিম জাফর এত দুর্দশার পরেও নারিন নিয়ে সহানুভূতি দেখিয়ে গেলেন বটে। বললেন যে, ‘‘নারিন যে এত দিন ধরে নিজের রহস্য ধরে রেখেছে, সেটাই তো বড় ব্যাপার।’’ কিন্তু মাঠে নামার পর নারিন নিয়ে এ সমস্ত আলগা সমীহ থাকবে তো? মনে তো হয় না।
ভরসা একটাই। পাঞ্জাব টিমটার ব্যাটিং তুখোড় হলেও (শিখর-লিভিংস্টোন-কারান-জিতেশরা সবাই দারুণ ফর্মে) বোলিং বেশ লঝঝড়ে। তা সে যতই কাগিসো রাবাডা আর অর্শদীপ সিং থাকুন না কেন। রাবাডা এতটাই মার খাচ্ছেন যে, তাঁর জায়গায় নাথন এলিসকে খেলানো যায় কি না, ভেবে দেখছে পাঞ্জাব। প্লাস, টিমে দরের স্পিনার নেই। রাহুল চাহার আর হরপ্রীত ব্রার। ইডেনে সোমবার টার্ন করলে নিঃসন্দেহে তখন অ্যাডভান্টেজ কেকেআর। এটা ঠিক যে, নাইট শিবিরে ২০১৪-র প্রত্যাবর্তন নিয়ে চর্চা চললেও (যে বার শেষ ন’টা ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কেকেআর) সেই টিম আর এই টিম এক নয়। কিন্তু তাতেও বা স্বপ্ন দেখতে দোষ কী? অনিশ্চয়তার অক্ষয় ব্র্যান্ড যে আজও ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্ক ব্যালান্স! আর কে না জানে, যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ!