সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামোল্লেখ ছিল না। ছিল না 'ভারততীর্থ' কবিতার উল্লেখও। কিন্তু 'ভারততীর্থে' কবিগুরুর যে মতাদর্শ প্রকাশ পেয়েছিল, তা-ই নস্যাৎ করে দিলেন মোহন ভাগবত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বঙ্গ সফরের পর দিনই কলকাতায় এসে সংঘ প্রধান বুঝিয়ে দিলেন রবি ঠাকুর নন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই তাঁদের অনুপ্রেরণা।
'ভারততীর্থে' রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন/ শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন/ পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার/ দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।" ভাগবত বুঝিয়ে দিলেন, তিনি কবিগুরুর এই ভাবধারার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না। সংঘ প্রধান জানালেন, ইংরেজরা তো অনেক পরে এসেছে। তার আগে শক-হুণ-পাঠান-মুঘল, যারাই ভারতে এসেছে, তারা কেউই ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। তারা সকলেই হানাদার ছিল।
ভাগবতের বক্তৃতায় উঠে এসেছে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমের 'বন্দে মাতরম' প্রসঙ্গও। সংঘ প্রধান বলেন, "বন্দে মাতরম আন্দোলন শুরুই হয়েছিল নাগপুরে। বন্দে মাতরম-কে ভয় পেয়েছিল ইংরেজরাও।" প্রসঙ্গত, গত কয়েক দিন ধরেই বঙ্গ-রাজনীতি আলোড়িত হয়েছে 'বন্দে মাতরম' নিয়ে। এই গান নিয়ে সংসদে আলোচনা চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী মোদি স্রষ্টা বঙ্কিমকে 'বঙ্কিমদা' বলে সম্বোধন করেছিলেন। তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। আসরে নামে বাংলার শাসকদল তৃণমূল। বিজেপিকে 'বাংলার সংস্কৃতির বিরোধী' বলে আখ্যাও দিয়েছে। এই আবহে শনিবার নদিয়ার তাহেরপুরে ফোন-ভাষণে বঙ্কিমকে 'ঋষি' এবং 'বাবু' বলে সম্বোধন করেছেন মোদি। যা রাজনৈতিক মহলের নজর এড়ায়নি। প্রধানমন্ত্রী 'ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করছেন' বলে তা নিয়ে কটাক্ষও করেছে তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতে ভাগবতও 'বন্দে মাতরম' প্রসঙ্গ টেনে বাঙালির বঙ্কিম-আবেগকে নাড়িয়ে দিতে চাইলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি উসকে দিতে চাইলেন বঙ্কিম বনাম রবীন্দ্র তরজাও।
রাজনৈতিক মহলের মত, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রকোপে বঙ্কিমচন্দ্র বনাম রবীন্দ্রনাথ তরজা অনেক দিন ধরেই চলছে। হিন্দুত্ববাদীরা বরাবরই বঙ্কিম-ঐতিহ্যকে সনাতনী বলে দেখতে চেয়েছেন। উল্টো দিকে রবীন্দ্রনাথের 'উদারবাদী' ভারধারা তাদের কাছে পরিত্যাজ্য। কবিগুরু যে 'ভারততীর্থ' তৈরির কথা বলেছিলেন, তা কখনওই গ্রহণযোগ্য ছিল না হিন্দুত্ববাদীদের কাছে। তারা রবীন্দ্রনাথের প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনাকে প্রতিহত করার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রকৃত সনাতনী রূপে তুলে ধরতে চাইছে। ঠিক একই ভাবে বাংলাদেশেও মৌলবাদীদের নিশানায় থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই কারণেই হামলা হয়েছে ছায়ানটে।
যদিও এই প্রচেষ্টা সফল হবে না বলেই মত অনেকের। সাহিত্যানুরাগীদের একাংশের মত, বঙ্কিমচন্দ্রকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনক হিসাবে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দু’জনের জীবন অনুসরণ করলে বোঝা যায়, বঙ্কিম কত ভাবে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরক, অগ্রপথিক, তাঁরা রাস্তা তৈরির অন্যতম কারিগর। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ, বন্দে মাতরম্ ও জনগণমন— এই দুইকে যাঁরা মিলিয়ে চলতে না পারেন, তারা আদতে বিপদ ডেকে আনছেন। প্রগতিশীল বাঙালির মননে বঙ্কিমচন্দ্র বনাম রবীন্দ্রনাথ এই তরজা কোনও দিন স্থান পায়নি এবং আগামী দিনেও পাবে না।
