স্টাফ রিপোর্টার: অন্তত এক মাস ধরে তিন-তিনটে রাজ্যে প্রায় চারশো কিলেমিটার সফর। শয়ে শয়ে বনকর্মীকে নাকানিচোবানি খাইয়ে রবিবার বাঁকুড়ার জঙ্গলে ঘুমপাড়ানি গুলিতে কাবু হয়ে খাঁচাবন্দি হওয়ার পরও দাপট কমেনি বাঘিনী জিনাতের। রবিবার মাঝরাতে তাকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় এনে সেখানকার পশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবার সকালের মধ্যে ঘুমের রেশ কাটিয়ে সে ফের চনমনে, দুপুরে লোহার খাঁচার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে পা বের করে রীতিমতো হুঙ্কার ছেড়েছে! শুনে হাঁফ ছেড়েছেন বনকর্তারা। বাঘিনির গর্জনই বুঝিয়ে দিয়েছে, শারীরিকভাবে সে একেবারে তরতাজা।
তবে অরণ্য ছেড়ে বদ্ধ খাঁচায় এসে মন ভার বাঘিনীর। যে কারণে খাবারেও অনীহা। এদিন সকালে চিকেন দেওয়া হলেও মুখে তোলেনি। এতে অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু দেখছেন না বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের বক্তব্য, এটা সাময়িক। জঙ্গলে শিকার করেও সে খেয়েছিল। তার পেট ভরা থাকতে পারে। সিসিটিভি-র মাধ্যমে জিনাতের উপর নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি চালাচ্ছেন চিড়িয়াখানার চিকিৎসকরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, আলিপুরে আসার পর জিনাতকে ওআরএস জল দেওয়া হয়েছিল, এদিন দিনভর তা খেয়েছে।
রবিবার বাঁকুড়ার জঙ্গল থেকে ধরা পড়েছে বাঘিনী জিনাত। নিজস্ব ছবি।
পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বন সংরক্ষক বন্যপ্রাণী এবং প্রধান বন্যপ্রাণী ওয়ার্ডেন দেবল রায় বলেন, ‘‘তিনজন বন্যপ্রাণী অভিজ্ঞ ডাক্তার, চিড়িয়াখানার বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বাঘিনীর খেয়াল রাখছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যাঁরা আছেন, তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে। তার শরীরে বাইরে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছে। এ কদিন জঙ্গলে পেট ভরে খেয়েছে, তাই বিশেষ খিদে নেই।''
তবে সিমলিপালের জিনাতকে আলিপুর চিড়িয়াখানা হাসপাতালে আনা নিয়ে গোড়া থেকেই ওড়িশা বনদপ্তরের আপত্তি ছিল। তাদের ইচ্ছে ছিল, জিনাতকে বাঁকুড়া থেকে সোজা সিমলিপালে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বনদপ্তরের বক্তব্য, বাঘিনী যেহেতু এ রাজ্যে ধরা পড়েছে, তাই তার প্রাথমিক চিকিৎসার দায়িত্ব ও কর্তব্য এ রাজ্যের। সেইমতো ব্যবস্থাও হয়েছে। হাসপাতালে জিনাতের জন্য বিশেষ ঘরের ব্যবস্থা করেছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেখানে তাকে রাখা হয়নি। সূত্রের খবর, ওড়িশার বন আধিকারিকরাই হাসপাতালের বিশেষ ঘরে তাকে ছাড়তে নারাজ। বাঁকুড়া থেকে লোহার বদ্ধ খাঁচার মধ্যে যেভাবে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল, তেমনভাবেই হাসপাতালে রয়েছে।
একফালি খাঁচার মধ্যে তার নড়াচড়ারও জায়গা নেই। এভাবেই বা তাকে কতদিন রাখা যাবে? এনিয়ে প্রশ্ন উঠেছে? যদিও রাজ্যের প্রধান বন সংরক্ষক বন্যপ্রাণী এবং প্রধান বন্যপ্রাণী ওয়ার্ডেন জানান, ''সিমলিপাল থেকে বিশেষজ্ঞ আধিকারিকরা প্রথম থেকে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। যেহেতু এটা তাদের জঙ্গলেরই বাঘ। বিভিন্ন সরঞ্জাম এবং পরামর্শ দিয়ে তাঁরাও হেল্প করেছেন করছেন। তিনি আরও বলেন, জিনাত বন্যপ্রাণী। তাকে স্বাভাবিকভাবে বন্য জীবনে ফেরত পাঠানোর একটা ব্যাপার রয়েছে। তাই মানুষের থেকে বা চিড়িয়াখানা থেকে যাতে কোনও সংক্রমণ না হয় সেই দিকটায় কড়া নজর রাখা হয়েছে।’’
তিন রাজ্যের বনাঞ্চলে দাপিয়ে বেড়িয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার জিনাত। নিজস্ব ছবি।
দীর্ঘদিন ধরে বাঘবন্দির লড়াই চলছিল। এতে বাঘিনির মানসিক প্রভাব পড়েছে বলে বাঘ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য কেমন তা জানতে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করার পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছিল আলিপুর পশু হাসপাতাল। তবে আলিপুর চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত তার মধে্য অস্বাভাবিক কিছু দেখা যায়নি। ঘুমপাড়ানি গুলির ঘোরও কেটে গিয়েছে। তাই মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করার প্রয়োজন নেই বলে কর্তৃপক্ষ মনে করছে।
জিনাতকে নিয়ে নবান্নও পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নিচ্ছে। এদিন দেবল রায় নবান্নে যান । সেখানে বাঘিনিকে নিয়ে আলোচনাও চলে বলে জানা গিয়েছে। এদিকে জিনাতকে দ্রুত ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে ওড়িশার বনদফতর। কিন্তু জিনাত কবে ফিরবে? আদৌ কি সে ওড়িশার সিমলিপালে ফিরে যাবে নাকি এখানেই থাকবে? এনিয়ে জল্পনা চলছে। একাংশ মনে করছে জিনাতকে রাজ্য বনদফতর বন্দি করেছে, আপাতত সে আমাদের। এদিন চিড়িয়াখানার দর্শকরাও জিনাতের খোঁজ নিয়েছেন। তাঁকে দেখার জন্য অনেক দর্শক আবার চিড়িয়াখানার বিপরীতে থাকা পশু হাসপাতালের সামনে ভিড় জমান। বনদপ্তরের একটি সূত্র অবশ্য জানাচ্ছে, বাঘিনীকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তবে কবে, যা তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এনিয়ে দুই সরকার আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।