সন্দীপ চক্রবর্তী এবং রূপায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: ৩১ মার্চ, ২০১৬। শীতলা অষ্টমীর পুজো চলছিল মন্দিরে। প্রচণ্ড জোরে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ। তারপর চিৎকারের আওয়াজ। পোস্তা মার্কেটে নিজের অফিসে কাজ করছিলেন। কাজ ফেলে ছুটে গিয়ে দেখেছিলেন সেই ভয়ংকর দৃশ্য। গণেশ টকিজে বিবেকানন্দ রোডের উপর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে ব্রিজ। মনে পড়লে এখনও শিউরে উঠি দাদা। কথাগুলি বলছিলেন পোস্তা এলাকার ব্যবসায়ী মনোজকুমার গুপ্তা। কর্মসূত্রে বড়বাজারে প্রতিদিন আসেন হাওড়ার কদমতলার বাসিন্দা সুদীপ দলুই। সেদিনও সকাল সকাল কাজে এসেছিলেন পোস্তার পিঁয়াজের গদিতে। ছুটে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। তারপর বেশ কয়েক রাত ঘুমোতে পারিনি। বলছিলেন সুদীপও।
পাঁচ বছর আগেও ভোট ছিল। এবারও সেই পাঁচ গড়িয়ে ভোট। দুই ভোটে অবশ্য অনেক অমিল। যদিও সেই বিবেকানন্দ উড়ালপুল ভেঙে পড়ার ঘটনা আজও অনেকের কাছে টাটকা। তাই এবার বিধানসভা ভোটেও ঘুরেফিরে উঠে আসছে সেই উড়ালপুল ভেঙে পড়ার ঘটনা। একসময় যে ঘটনা নিয়ে চলেছিল শাসক-বিরোধী রাজনৈতিক চাপানউতোর। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেই উড়ালপুল ইস্যু বিরোধীদের কাছে হয়ে উঠেছিল প্রধান অস্ত্র। এবারও প্রচারে বিজেপি তুলে ধরছে সেই উড়ালপুলের ঘটনাকে। গণেশ টকিজের কাছে ব্রিজের যে অংশটি ভেঙে পড়েছিল তার আগে ও পরে ব্রিজটির ঢাকা অংশ নেই। কিন্তু বেশ কিছু অংশ আবার ঢাকাই রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পথচলতি নাগরিকদের আশঙ্কা, আবার বাকি ঢাকা অংশটুকুও যে কোনওদিন ভেঙে পড়বে না তার গ্যারান্টি কোথায়? এটাকেই প্রচারে তুলে ধরছেন বিজেপি প্রার্থী মীনাদেবী পুরোহিত। মীনাদেবীর কথায়, উড়ালপুলের বাকি অংশ এখনও ভেঙে ফেলা হয়নি। যথেষ্ট ‘রিস্ক’ রয়েছে। নতুন করে না হলে ভাঙা অংশ খুলে দেওয়া উচিত। নিকাশি সমস্যা নিয়েও সরব বিজেপি প্রার্থী। তাঁর অভিযোগ, মহাজাতি সদন সংলগ্ন এলাকা, ঠনঠনিয়া, কলুটোলাতে জলনিকাশি ব্যবস্থা বেহাল।
[আরও পড়ুন : ‘শুধু তৃণমূলের অক্সিজেন কম পড়ছে, বিজেপির দায় নাকি?’, খোঁচা দিলীপের]
শাসকদলের হাতে থাকা এই জোড়াসাঁকো (Jorasanko) কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক স্মিতা বক্সিকে এবার প্রার্থী করেনি তৃণমূল। এখানে এবার তৃণমূল প্রার্থী বিবেক গুপ্তা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নমূলক কাজকে হাতিয়ার করেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন বিবেক গুপ্তা। একের পর এক যুক্তি দিয়ে বিরোধীদের দিকে আক্রমণ শানাচ্ছেন তিনি। বিবেক গুপ্তা রাজ্যসভা থেকেও জিতেছিলেন। তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করেছিল। একটি হিন্দি দৈনিকের সম্পাদক তিনি। তাঁর মতো হেভিওয়েট একজনকে এবার বিধানসভায় জোড়াসাঁকো থেকে প্রার্থী করে এই কেন্দ্রে বিজেপিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে তৃণমূল। তৃণমূলের লক্ষ্য জোড়াসাঁকো কেন্দ্রের বড় অংশের হিন্দিভাষী মানুষের ভোট নিজেদের ঝুলিতে নিয়ে আসা।
বিবেক গুপ্তার কথায়, “সকলে বলছে নিজের দলকে ভোট দাও। জোড়াসাঁকোর কথা কেউ ভাবছে না বা বলছে না। আমি আমার বিরোধী দুই প্রার্থী মীনাদেবী পুরোহিত ও আজমল খানকে বলছি, খোলা মঞ্চে একটা ‘লাইভ ডিবেট’ হোক। সেখানে জোড়াসাঁকোর বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হোক। যে কোনও ইস্যু নিয়ে বিরোধীরা বলুক, আমি উত্তর দিয়ে দেব।” জোড়াসাঁকোর উন্নয়ন নিয়ে জোড়াসাঁকো ডট কম নামে একটি ওয়েবসাইটও চালু করতে চলেছেন বিবেক গুপ্তা। অন্যদিকে, বিজেপি প্রার্থী মীনাদেবী পুরোহিতের পালটা বক্তব্য, যদি মুখোমুখি বসার সুযোগ হয় তাহলে জোড়াসাঁকো এলাকার কী কী উন্নয়ন হয়নি তা তথ্য দিয়ে তুলে ধরব। বিবেক পায়ে হেঁটে সেই উন্নয়নের বার্তাই দোরে দোরে গিয়ে বলে ফিরছেন। তিনি যেন জোড়াসাঁকোর উন্নয়নের নতুন ফেরিওয়ালা।
[আরও পড়ুন : ফের রণক্ষেত্র মানিকতলা, মহিলা তৃণমূল কর্মীদের ‘শ্লীলতাহানি’, কাঠগড়ায় বিজেপি সমর্থক]
তাঁর মোকাবিলায় ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ২৫ বছরের কাউন্সিলরকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে এই জোড়াসাঁকো থেকে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন মীনাদেবী। তখন তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন। মীনাদেবীর দাবি, জয় নিয়ে তিনি নিশ্চিত। আর এই দুই হেভিওয়েটের লড়াইয়ে ভাল ফলের আশায় কংগ্রেস প্রার্থী আজমল খানও। রাজনৈতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের স্মিতা বক্সি জিতেছিলেন ৬,২৯০ ভোটে। বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিনহা ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু তারপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলেছে। আবার গত ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের নিরিখে এই জোড়াসাঁকো বিধানসভা কেন্দ্রে ৩,৮৮২ ভোটে লিড রয়েছে বিজেপির। ফলে নতুন অঙ্ক কষছে গেরুয়া শিবির। লোকসভার ফলাফল ধরে রাখতেই মরিয়া তারা। আর শাসকদল তৃণমূল তাদের গড় ধরে রাখতে চাইছে।
উত্তর কলকাতার কালীকৃষ্ণ টেগোর স্ট্রিট, মুক্তারাম বাবু স্ট্রিট কিংবা মহর্ষি দেবেন্দ্র রোড। পুরনো কলকাতার বনেদিয়ানার প্রতীক বিশাল বিশাল দালানবাড়ি। আবার এই এলাকাকে বিশ্ব চেনে ঠাকুরবাড়ি দিয়েও। এই উত্তরেই রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দর বাড়ি, ভূতনাথ মন্দির, ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। উত্তর কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রাণকেন্দ্র পোস্তাও এই জোড়াসাঁকো কেন্দ্রের মধ্যে। পোস্তা এলাকাতেও রয়েছে বড় ভোটব্যাংক। সব দলই প্রচার চালাচ্ছে। অবাঙালি ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসাতে চাইছে গেরুয়া শিবির। পোস্তা বাজারে শৌচালয় থেকে শুরু করে নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন সেখানকার অনেক ব্যবসায়ী থেকে দোকানিরা। পোস্তার পিঁয়াজ আড়তের কর্মচারী অরবিন্দ ঘোষ ও তন্ময় ঘোষদের এমনই অভিযোগ। আবার রাজেন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটের বাসিন্দা কুমুদ শর্মার কথায়, তৃণমূলের আমলে এলাকায় রাস্তাঘাট থেকে স্ট্রিট লাইট, যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নকে অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে ভোট চাইছে শাসক তৃণমূলও। পালটা নাগরিক পরিষেবা, বেহাল নিকাশিকে পালটা ইস্যু করেছে বিজেপি ও কংগ্রেস।