বিশ্বদীপ দে: এম এল জয়সীমা। আজকের প্রজন্ম কি জানে তাঁর নাম? জানলে নিঃসন্দেহে রবিবাসরীয় সকালে, ভাইফোঁটার ফাঁকে টিভি, মোবাইলের পর্দায় চোখ রেখে হতাশ হওয়ার সময় এই নাম তাঁদের মনে পড়ে যেতে পারে। ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম গ্ল্যামারাস ক্রিকেটার ধরা হয় জয়সীমাকে। কলার তুলে মাঠে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি তিনি ব্যাটার হিসেবে ছিলেন দলের স্তম্ভ। ইডেনে ১৯৫৯-৬০ সালের এক টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচদিনই ব্যাট করার নজির ছিল তাঁর। এছাড়াও বহু ম্যাচ তাঁর ব্যাটিংয়ের ভরসায় বাঁচাতে পেরেছিল দল। রবিবার রোহিত-কোহলিদের আত্মসমর্পণ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ইস! এই দলে যদি একজন জয়সীমা থাকতেন। কেবলই আক্রমণ, কেবলই স্ট্রাইক রেটের এই পৃথিবীতে রক্ষণাত্মক খেলাটাই যেন ডাইনোসরদের মতো বিলুপ্ত হওয়ার পথে। আর তারই খেসারত দিতে হল টিম ইন্ডিয়াকে। দুই যুগ পর চুনকাম হতে হল দেশের মাটিতে।
জিততে হলে করতে হত ১৪৭ রান। সবে ম্যাচের তৃতীয় দিন। কিন্তু রোহিতদের দেখে মনে হচ্ছিল তাঁরা টি২০ খেলার মেজাজে রয়েছেন। অথচ পিচ আদৌ ব্যাটিংবান্ধব নয়। বল ঘুরছে। তার উপরে সিরিজে ০-২ পিছিয়ে থাকার অস্বস্তিও রয়েছে। এমতাবস্থায় সিরিজ খুইয়েও সম্মান বাঁচাতে দরকার ছিল দেড়শোরও কম টার্গেট পূরণ করা। কিন্তু রোহিত শর্মা সপাটে পুল করতে গেলেন। হেনরির বলটা খুব আহামরি ছিল না। কিন্তু ততটা শর্ট ছিল না, যতটা রোহিত ভেবেছিলেন। ফলে খানিক দেরিতে খেলেও ম্যানেজ করা যায়নি। টপ এজ লেগে শূন্যে উঠে যায় বল। এই উইকেটের পতনেই যেন লেখা ছিল টিম ইন্ডিয়ার ম্যাচ-ভাগ্য।
জয়সীমার মতো ক্রিকেটার আজ কোথায়?
একই ভাবে সরফরাজ কিংবা অশ্বিনের আউট হওয়া দেখে বোঝাই মুশকিল টেস্ট চলছে। ২৮ রানে চার উইকেট হারানো অবস্থায় ব্যাট করতে নেমেই ফুলটস বলকে সুইপ করে ক্যাচ দিয়ে আউট হলেন সরফরাজ। অশ্বিন গেলেন রিভার্স সুইপ মারতে গিয়ে। মনে রাখতে হবে ৬টা টেস্ট সেঞ্চুরি রয়েছে তাঁর। কাজেই তিনি টেল এন্ডার, একথা বলা অর্থহীন।
তবে একথা বলাই যায় যে, সকলেই মারতে গিয়ে উইকেট ছুড়ে দিয়ে এসেছেন তা নয়। কিন্তু যেভাবে বাকিরা আউট হলেন তা আসলে রক্ষণাত্মক খেলার ত্রুটির জন্য। শুভমান গিল আউট হলেন বল ছাড়তে গিয়ে। এমন একটা পিচ, যেখানে বনবন করে বল ঘুরছে। সেখানে স্টাম্প পুরোপুরি কভার না করে বল ছাড়াটাই কাল হল তাঁর। কোহলি সামনে পা বাড়িয়ে ডিফেন্স করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বলের লেংথ পুরোপুরি না বুঝতে পারার খেসারতই দিতে হল তাঁকে। জাদেজাও আউট হলেন স্পিনটা ম্যানেজ না করতে পেরে ক্লোজ ইন ফিল্ডারকে ক্যাচ দিয়ে।
এমনই সব দৃশ্য। ভারতীয় খেলোয়াড়দের আউট হওয়ার ভঙ্গি থেকে এটা পরিষ্কার, এই ধরনের পিচে টেস্ট ক্রিকেটে কীভাবে টিকে থাকতে হবে সেটাই যেন তাঁরা ভুলে গিয়েছেন। ঋষভ পন্থ অনবদ্য খেলেছেন। তাঁর ৬৪ রানের ইনিংসটি ছাড়া ভারত আজ ৫০ও পেরোত কিনা সন্দেহ। পন্থের আউট হওয়াটাও দুর্ভাগ্যের। কিন্তু সার্বিক ভাবে তাঁর খেলাতেও রক্ষণ ততটা জোরালো নয় কোনওদিনই। তবে একটা কথা মানতেই হবে। স্বভাবগত ভাবেই এই ধাঁচের ব্যাটিং তিনি করে থাকেন। দলের এক-আধজন এমন ক্রিকেটার অনেক সময়ই অপ্রত্যাশিত সাফল্য এনে দিতে পারে। কিন্তু সার্বিক ভাবে ব্যাটসম্যানদের মানসিকতা সব সময়ই ফিফথ গিয়ারে থাকাটা টেস্ট ক্রিকেটের অনুসরণযোগ্য ব্যাটিং কৌশল হতে পারে না।
৫০ ওভারের ক্রিকেটের চেয়েও টি২০ ক্রিকেটে আক্রমণের ঝাঁজ আরও বেশি থাকে। সারাক্ষণ খুড়োর কলের মতো স্ট্রাইক রেটের জুজু সামনে ঝুলিয়ে খেলতে হয়। যেনতেন প্রকারেণ রান করাটাই সেখানে আসল উদ্দেশ্য। সেই মনোভাবের ছায়া পড়েছে পাঁচদিনের ক্রিকেটে। আর সেই কারণে ড্র ব্যাপারটাই আজ একরকম অবলুপ্ত। নির্ধারিত পাঁচদিনের আগেই দ্রুত ফয়সলা হয়ে যাচ্ছে ম্যাচের। দেখতে চমৎকার লাগছে। কিন্তু এই দ্রুততার ভিতরে কোথায় যেন গায়েব ভালো একটা বল, যেটায় রান করা মুশকিল সেটাকে ডিফেন্স করার কৌশল। এই রক্ষণ ও আক্রমণের মিশেল হল টেস্ট ব্যাটিং। এক অনন্ত ধৈর্যের পাল্লায় নিজেকে সেঁকে বেড়ে নিয়ে ইনিংসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই টেস্ট ব্যাটিংয়ের প্রাণভোমরা। বিশেষ করে যেখানে পিচ বোলারকে সাহায্য করছে, সেখানে বলের মেধা অনুযায়ী খেলতে না পারলে সাফল্য পাওয়া কঠিন। এদিন বিরাট, রোহিতদের ব্যাটিং সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিল। সামনেই অস্ট্রেলিয়া সফর। অজিদের বিরুদ্ধে জিততে হলে স্ট্রোক খেলতেই হবে। কিন্তু সেই সঙ্গেই অফস্টাম্পের বাইরে 'অনিশ্চয়তার করিডরে' আসা টোপ থেকে নিজেদের সংযত রাখাও শিখতে হবে রোহিতদের। না হলে ফের লজ্জাকে সঙ্গী করে মাঠ ছাড়তে হবে।