সুমিত বিশ্বাস, কোটশিলা (পুরুলিয়া): ঝাড়খণ্ড (Jharkhand) ছুঁয়ে থাকা কোটশিলা বনাঞ্চল এখন চিতাবাঘের ঘরসংসার। আর তার ‘পাহারাদার’ সিমনি-জাবর। গত বর্ষায় পুরুলিয়ার কোটশিলা বনাঞ্চলের সিমনি বিটের সিমনি-জাবর জঙ্গলে মিলনকালেই জোড়া চিতাবাঘের রহস্যভেদ হয়েছিল বন দপ্তরের ট্র্যাপ ক্যামেরায় স্ত্রী চিতাবাঘ ধরা দেওয়ায়। এই জঙ্গলে গত ফেব্রুয়ারির শেষে একইভাবে ট্র্যাপ ক্যামেরায় পুরুষ চিতাবাঘ ধরা পড়েছিল। ফলে বন দপ্তর চাইছিল, এই চিতাবাঘ শাবকের জন্ম দিক। তাই জঙ্গলকে কার্যত ঘিরে রাখা হয়েছিল। যাতে মিলনের মরশুমে একেবারে নিশ্চিন্তে জুটি বাঁধতে পারে। অবশেষে এল খুশির খবর। চিতাবাঘটি জন্ম দিয়েছে শাবকের।
সেই সংখ্যাটা কত তা সুনির্দিষ্টভাবে বন দপ্তর না জানাতে পারলেও শাবকের সংখ্যা একাধিক বলছেন পাহাড়তলির মানুষজন। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলে চিতার এমন ঘরসংসারে বেজায় খুশি অরণ্য ভবন। রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “খুশির খবর। বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাব। ওই শাবকগুলির নামকরণ করবেন তিনিই।” চিতাবাঘের পরিবার যাতে কোটশিলা বনাঞ্চলের জঙ্গলে সুরক্ষিত থাকতে পারে তাই নজরদারি আগের চেয়ে আরও বাড়ানো হয়েছে। তবে এবার চিতাবাঘ শাবকের ছবি বন দপ্তরের ট্র্যাপ ক্যামেরায় নয়, বন্দি হয়েছে স্থানীয় এক যুবকের মোবাইল ক্যামেরায়। আর সেই ছবি সংগ্রহ করেছে কোটশিলা বনাঞ্চল ও পুরুলিয়া বনবিভাগ।
[আরও পড়ুন:প্রথা ভেঙে নতুন সভাপতির বাড়ি গিয়ে শুভেচ্ছা সোনিয়ার, খাড়গের সাফল্য কামনা মোদির]
কোটশিলা বনাঞ্চল সূত্রে জানা গিয়েছে, সিমনি-জাবর পাহাড়ের জঙ্গলের একটি গুহায় চিতাবাঘ শাবকের জন্ম দেয় চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষের দিকে। তারপর ওই জঙ্গলে বনজ সম্পদ কুড়োতে গিয়েই চিতাবাঘের শাবকের ছবি পাওয়া যায়। সেই ছবি এবার সামনে এল। তবে এখানেই শেষ নয়। এই পাহাড়তলি এলাকার মানুষজন দেখেছেন, শাবককে মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে মা। দেখেছেন জঙ্গল জুড়ে অজস্র পায়ের ছাপ। প্রায় ১৫ দিন আগে সিমনির জঙ্গলেই এক সপ্তাহের মধ্যে পরপর দু’বার একটি বাছুরকে ধরার চেষ্টা করেছিল চিতাবাঘ। কিন্তু বাগে আনতে পারেনি। এলাকার বাসিন্দাদের ধারণা, ওই বন্যপ্রাণীটি ছিল চিতাবাঘটির শাবক। হয়তো মা তার শাবককে শিকারের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।
সিমনি গ্রামের বাসিন্দা তথা ওই জঙ্গলে বনজ সম্পদ কুড়োতে যাওয়া এতোয়ারি কিস্কু বলেন, “এই তো কয়েকদিন আগেকার কথা। এক সপ্তাহের মধ্যে দু’ দুবার একটা বাছুরকে ধরার চেষ্টা করেছিল ওই চিতা বাঘ। কিন্তু বাছুরকে ধরতে পারেনি। দুবারই কোনওক্রমে সে পালিয়ে যায়। আমাদের ধারণা, ওটা মায়ের সঙ্গে থাকা চিতাবাঘ শাবকই হবে।” সিমনি-জাবর গ্রামের বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলছেন, এখন নাকি ওই চিতাবাঘের পরিবার এই জঙ্গল থেকে অন্যত্র গিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন এই সিমনি-জাবর পাহাড়ের সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের সেওয়াতি পাহাড়ের যোগ রয়েছে। সেখানে চলে গিয়েছে ওই চিতাবাঘের পরিবার । সিমনি গ্রামের কৃষক রেংটু বেশরা বলেন, “শাবক নিয়ে মা চিতাবাঘের ঝাড়খণ্ডে যাওয়া-আসা আছে। তবে সিমনি -জাবর জঙ্গল তাদের এখন স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গিয়েছে।”
[আরও পড়ুন:গুরুগ্রামে উদ্ধার স্যুটকেসবন্দি নগ্ন যুবতীর দেহ, যৌনাঙ্গে ক্ষত, ধর্ষণ করে খুনের আশঙ্কা পুলিশের]
জাবর গ্রামের করণ হেমব্রম বলেন, “এই কয়েক মাসে এই জঙ্গলে চিতা বাঘের বারে বারে পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছে। একটা পূর্ণবয়স্ক আর দুটো ছোট ছোট।” চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম রাত ন’টা ৫১মিনিটে ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা দিয়েছিল হৃষ্টপুষ্ট পুরুষ চিতাবাঘ। এর ঠিক দু’মাস পরে ২০ এপ্রিল রাত ৭ টা ২০ মিনিটে ফের ট্র্যাপ ক্যামেরায় ধরা দেয় ওই পুরুষ চিতাবাঘটি। তারপর গত ২৯ জুন ভোর চারটে ৫৮ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে যে চিতাবাঘটি ট্র্যাপ ক্যামেরায় ওই জঙ্গলে ধরা পড়ে সেটি ছিল স্ত্রী। তারপর থেকেই উল্লসিত বন দপ্তর ।
পুরুলিয়া বিভাগের ডিএফও দেবাশিস শর্মা বলেন, “শুনেছি ওই জঙ্গলে চিতাবাঘ শাবকের জন্ম দিয়েছে। এবার ধারাবাহিকভাবে যেভাবে বৃষ্টি চলছে তাতে কয়েকটি ট্র্যাপ ক্যামেরা খারাপ হয়ে যাবার পর লাগাতে পারছি না। তবে আর কয়েক দিনের মধ্যেই ওই ক্যামেরা আমরা লাগিয়ে দেব। কোটশিলা বনাঞ্চল চিতাবাঘের বিচরণ ক্ষেত্র হওয়া থেকেই প্রমাণ করে জঙ্গল ক্রমশ বাড়ছে।” সেইসঙ্গে ভরা জঙ্গলে চিতার পরিবারকেও রীতিমতো ‘পাহারাদারে’র ভূমিকা নিয়ে আগলে রেখেছে। আসলে ২০১৫ সালের ২০ জুনের অতীতকে ভুলতে চায় কোটশিলা। এই বনাঞ্চলের টাটুয়ারার লোকালয়ে চলে এসেছিল একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ চিতাবাঘ। তারপর তাকে পিটিয়ে মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেটে নেওয়া হয়েছিল শরীরের একাধিক অঙ্গ। বন্যপ্রাণের চেয়েও হিংস্র হয়ে হত্যা করা হয়েছিল ওই পূর্ণবয়স্ক পুরুষ চিতাবাঘকে। সিমনি জাবর পাহাড়ে সেই চিতার সংসার এখন ‘পাহারাদারে’র ভূমিকায় আগলে রেখে অতীতের ওই তকমা ঘোচাতে চায় কোটশিলা বনাঞ্চল।