বিশ্বদীপ দে: স্বপ্নপূরণের রাত। এককথায় আজকের রাতকে ব্যাখ্যা করা যাবে কি কেবল এইটুকু বলে? আদৌ কি কোনও ভাবেই ব্যাখ্যা করা যাবে? ২০১৪ সালে হয়নি। একেবারে শেষ মুহূর্তে হিগুইনের গোল মিস আর মারিও গোৎজের অসামান্য গোলে স্বপ্নভঙ্গের পর মেসির (Lionel Messi) শূন্যদৃষ্টি আজ থেকে অতীত। সমস্ত তাচ্ছিল্য, অপমান, শোকের এবার থেকে ছুটি। ৭ বারের ব্যালন ডি'অর জিতেও যেন সবটা জিতে ওঠা যাচ্ছিল না। কিন্তু রবিবাসরীয় মহারণে ফ্রান্সকে হারিয়ে আর্জেন্টিনার (Argentina) বিশ্বজয়ের পর আর কোনও অপ্রাপ্তি রইল না লিওনেল মেসির। হ্যাঁ, দিয়েগো মারাদোনার (Diego Maradona) অলৌকিক দ্যুতিকেও বুঝি স্পর্শ করে ফেললেন। হয়ে উঠলেন রাজার রাজা।
কবে শুরু হয়েছিল তাঁর যুদ্ধ? তখন বয়স মাত্র ১৩। আর্জেন্টিনা ছেড়েছেন। ততদিনে সকলেই বুঝতে পেরেছেন ঠিকমতো প্রশিক্ষণ পেলে এই ছেলে অনেক দূর যাবে। কিন্তু এত প্রতিভা সত্ত্বেও তাঁর দৈহিক বৃদ্ধি ততটা হচ্ছিল না। আর তাই নিয়মিত বৃদ্ধির হরমোন ইনজেক্ট করাতে হচ্ছিল শরীরে। এফসি বার্সেলোনা সেই খরচ বহন করেছিল। এরপর ২০০৫ সালের মধ্যে বার্সার প্রথম দলে ঢুকে পড়েন। আর অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপে দেশকে কাপ এনে দিয়ে হয়ে ওঠেন জাতীয় তারকা। সেই শুরু। সেই থেকেই প্রত্যাশার পারদ তাঁকে ঘিরে আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু সেই প্রত্যাশাকে চাপ হয়ে উঠতে দেননি মেসি। বরং সেটাকেই উদ্দীপনার অস্ত্র করে দ্রুত পেরতে থাকেন একের পর এক মাইলফলক। মাত্র কয়েক বছর- বলা যায় ২০১১ সালের মধ্যেই তিনি বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের সরু গলির বাসিন্দা। মারাদোনা-পেলের সঙ্গে তুলনীয়। খোদ মারাদোনাও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন স্বদেশীয় এই জিনিয়াসকে।
[আরও পড়ুন: ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিশ্বকাপ পাবেন মেসিই! মহারণের আগে ভাইরাল ৭ বছরের পুরনো টুইট]
কিন্তু... একটা বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলেই ছিল। সেটা বিশ্বকাপ না জেতাতে পারার জন্য নয়। সেটা 'দেশভক্তি' সংক্রান্ত সংশয়। বিশ্বের ধনীতম ক্লাবে খেলেছেন। কিন্তু স্বদেশীয় ক্লাবে খেলেননি। এমনকী, খেলা শুরুর আগে জাতীয় সংগীতও নাকি গাইতে দেখা যায় না তাঁকে! এমন গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। কেউ ভেবেও দেখেনি, এমন অভিযোগে বিদ্ধ হয়ে কতটা কষ্ট পেয়েছেন মেসি। ক্লাবের হয়ে যতটা মনোযোগী, ততটা দেশের জন্য নন- এই অপবাদ এবার ডোডোপাখির মতোই বিলুপ্ত হয়ে গেল।
এর সঙ্গে জুড়তে হবে রোনাল্ডোর সঙ্গে তুলনা। ফুটবল দলগত খেলা। তবু একা 'বিশ্বরূপ' দেখানোর সুযোগ নির্মাণ করে মহাতারকা। সিআর৭ ও এলএম১০- দুই জিনিয়াসকে তাই দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে লড়ে গিয়েছেন অনুরাগীরা। মেসিরা নিজেরাও কি জড়িয়ে পড়েননি এই লড়াইয়ে? সামনাসামনি অবশ্য রোনাল্ডো কিংবা মেসি কেউ কাউকে খাটো করেননি। কিন্তু চাপটা ছিলই। এবং সেটাও কিছু কম চ্যালেঞ্জের নয়। বিশ্বজয়ের পরও হয়তো এই বিতর্ক থাকবে। কিন্তু বিশ্বকাপের দ্যুতি যে মেসিকে এগিয়ে রাখবে তাতে সন্দেহ নেই। যদিও দুই মহান তারকার মধ্যে অনর্থক তুলনাকে পিছনে রাখাই কাম্য। কিন্তু আমরা বলতে চাইছি মেসিকে এই মহাচাপকেও সঙ্গী করেই খেলতে নামতে হয়েছে। তারপরও জিতিয়ে দিলেন বিশ্বকাপ। আর এই জায়গাতেই তিনি হয়ে রইলেন অতুলনীয়।
যত এগিয়েছে এবারের বিশ্বকাপ (Qatar World Cup 2022) ততই যেন স্পষ্ট হয়েছে আর্জেন্টিনা বিশ্বজয়ী হতে চলেছে। ততই কি চাপ বাড়েনি মেসির উপরে? নিশ্চিত ভাবেই মনে পড়েছে অতীতের সব ব্যর্থতার স্মৃতি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বিতর্ককে উড়িয়ে 'মুকাদ্দর কা সিকান্দর' হয়ে উঠলেন তিনি। দলগত জয়ের পাশাপাশি এই ব্যক্তিগত শৃঙ্গ আরোহণ তাঁকে পৌঁছে দিল এমন এক স্তরে যেখানে পৌঁছনো বহু জিনিয়াসেরও স্বপ্ন হয়ে রয়ে গিয়েছে।
রবিবার রাতে নিশ্চিত ভাবেই এসে পড়ছে আর একটা নাম। তিনি দিয়েগো মারাদোনা। মহামহিম পেলের হিমালয়সম অস্তিত্ব বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল ১৯৮৬ সালে। বলা হয়, রাতারাতি সর্বকালের সেরা লড়াইয়ে সেই সময় থেকেই আর একমেবাদ্বিতীয়ম থাকেননি পেলে। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে তিনটি যুগ। পেলে-মারাদোনার সঙ্গে একাসনে এবার থেকে মেসিকেও রাখতেই হবে। দিয়েগো আর নেই। কিন্তু যদি মৃত্যু-পরবর্তী জীবন বলে কিছু থাকে, আজ নিশ্চয়ই আশ্চর্য হাসিতে ফেটে পড়ছেন তিনি। দেখছেন, তাঁরই মতো দৈর্ঘ্য, তাঁরই মতো বাঁ পায়ের খেলোয়াড় স্বদেশীয় লিও কী অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়ে ফেলেছেন! হয়তো আপসোসও একটা হবে। যদি ২০১০ সালে তিনি কোচ থাকা অবস্থায় মেসি জিততেন বিশ্বকাপ? তারপর হয়তো ভাববেন, যখন যেটা ঘটে তখনই আসলে সেটার সময়। কেরিয়ারের সায়াহ্নে পৌঁছে জাদুকর মেসির কথা ভাবতে বসলে নিজেকেও তাঁরই সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভেবে কি আনন্দাশ্রু বয়ে যাবে না তাঁর চোখেও? আজ থেকে যে দুটো নাম আরও বেশি করে পাশাপাশি উচ্চারিত হবে তাঁর দেশে। মেসি-মারাদোনা রবিবার রাত থেকে এক অভিন্ন বিজয়ী সত্তা।
১৮ ডিসেম্বরের কাতার জন্ম দিয়ে গেল এমনই সব মুহূর্তের, যা না জন্মেও ঝলমলিয়ে উঠল ফুটবল ফ্যানদের স্বপ্নে। বুঝিয়ে দিয়ে গেল আজ থেকে বিজয়ীর সমার্থক শব্দ লিওনেল মেসি।