অনুরাগ রায়: অধীর চৌধুরী। একদা বহরমপুরের 'সামন্ত'রাজা। নায়েব-সান্ত্রীরা আগেই সঙ্গ ছেড়েছেন। সাম্রাজ্যও জরাজীর্ণ, ফুটিফাটা হয়ে বহরে অনেক ছোট। কোনওমতে নিজের থানখানি রক্ষা করে রেখেছেন। এবার সেটাও পারবেন কিনা সংশয়। সেই সংশয়ের মধ্যে রুপোলি রেখার মতো দেখা মিলেছে মুক্তির পথের। যার অধীনে তাঁর ছোট্ট 'সাম্রাজ্য' তিনিই বলে দিয়েছেন, হয় নির্দেশ মানুন, নয় রাস্তা মাপুন। সেই রাস্তা মাপার নিদান কিন্তু অধীরের জন্য শাপে বরও হতে পারে। কীভাবে? সেটা বলার আগে বলে রাখা দরকার, অধীরকে কেন সামন্ত রাজা বলা হল।
অধীর চৌধুরীর রাজনৈতিক উত্থান মুর্শিদাবাদে। এ যাবৎ তিনি মুর্শিদাবাদ, বলা ভালো বহরমপুর কেন্দ্রিক রাজনীতি করে গিয়েছেন। দলের দৈন্যের দরুণ তাঁকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ তথা লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতার পদ দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু অধীর বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদের বাইরে কোনওদিন বেরোতে পারেননি। কংগ্রেস যখন গোটা দেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করে রেখেছিল, তখনও পারেননি। কংগ্রেসের চরম দৈন্যদশাতেও পারেননি। সেভাবে ভাবলে কংগ্রেস নামক সাম্রাজ্যের এক সামান্য সামন্তরাজা অধীর চৌধুরী। যে রাজা নিজের জৌলুস হারিয়েছেন। যে রাজার সাঙ্গপাঙ্গরা আজ পাশে নেই। প্রতিনিয়ত 'হানাদার'দের (তৃণমূল এবং বিজেপি) হানা। এমনকী তাঁর সম্রাটও (কংগ্রেস হাইকম্যান্ড) পাশে নেই। অতএব বিকল্প একটাই, নিজের সম্রাটের সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা, এবং নিজের অবশিষ্ট রাজপাট নিয়ে অন্য সাম্রাজ্যের শামিল হওয়া। অধীরের কাছেও বিকল্পটা সেই একই।
[আরও পড়ুন: ভুয়ো সার্টিফিকেট নিয়ে শিক্ষকতা! বাগুইআটির নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ]
কেন? ২০২৪ লোকসভা নির্বাচন ধরলেই বোঝা যায়। এআইসিসি রাজ্যে বরাবর তৃণমূলের সঙ্গে জোটের পক্ষে ছিল। এমনকী আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার পরও তৃণমূলকে আক্রমণ করার পথে হাঁটেনি কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব। রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গেরা ভোটপ্রচারে রাজ্যকে ব্রাত্য করে রেখেছেন স্রেফ তৃণমূলকে আক্রমণ করতে চান না বলেই। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব বিস্তর বুঝেছে, যে এটা রাজ্যের ভোট নয়। এক্ষেত্রে মূল শত্রু বিজেপি, তৃণমূল নয়। আর বিজেপিকে দিল্লি থেকে উৎখাত করতে তৃণমূলের সহযোগিতা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। সেখানে অধীর চৌধুরী রাজ্যে দাঁড়িয়ে লাগাতার তৃণমূলের মুণ্ডপাত করেছেন। ঠিক যে সুরে বিজেপি নেতারা কথা বলেন, সেই সুরেই আক্রমণ শানিয়ে গিয়েছেন রাজ্যের শাসকদলকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বারবার দেখা গিয়েছে একই ইস্যুতে AICC এবং প্রদেশ কংগ্রেস আলাদা আলাদা অবস্থানে। প্রদেশের অবস্থান মিলে গিয়েছে বিজেপির সঙ্গে। যাতে আদপে ক্ষতি ইন্ডিয়া জোটের।
[আরও পড়ুন: একবছরে বেড়েছে ১২০০ কোটি, রাজা চার্লসকে টপকে ধনীতমদের তালিকায় ঋষি সুনাক!]
এখানেই শেষ নয়, বারবার অভিযোগ উঠেছে অধীর চৌধুরী জিততে সাহায্য নেন বিজেপির। এমনকী তিনি মোদির 'প্রিয়পাত্র', যোগীর 'বন্ধু' বলেও শোনা যায়। তাৎপর্যপূর্ণভাবে মোদি রাজ্যজুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ সভা করলেও লোকসভায় অধীরের বিরুদ্ধে সভা করেননি। জেপি নাড্ডা, যোগী আদিত্যনাথরা বহরমপুরে এসেও অধীরের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেননি। বিজেপি যে অধীরের জয়ের রাস্তায় কণ্টক বিছোতে চায়নি, সেটা স্পষ্ট। তাঁর প্রতিদান অধীরও দিয়েছেন, বারবার তৃণমূলকে আক্রমণ করে। এর পর বহরমপুরের ভোট মিটতেই জোরালো থাপ্পড়টা খেতে হল তাঁকে। দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলে দিলেন, মমতাকে আক্রমণ বরদাস্ত করা যাবে না। তিনি ইন্ডিয়া জোটের সদস্য। এটা মানতে হবে, নয় তো নিজের রাস্তা খুঁজে নিতে হবে। অর্থাৎ, যে রাজনীতিটা অধীর করছিলেন, কংগ্রেস সেটাকে বরদাস্ত করবে না। সঙ্গে সঙ্গে বিজেপিও বলে দিল, বিভীষণের ঘরে থেকে তৃণমূল বিরোধিতা সম্ভব নয়। অতএব রামের ঘরে আসুন।
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? অধীর চৌধুরীকে কংগ্রেস সাফ বলে দিল, পার্টি লাইনে আসুন, নয়তো পথ ছাড়ুন। বিজেপি বলে দিল, আপনি যে পথে হাঁটছেন, সে পথ আমাদেরই। অতএব আপনি চাইলে হাঁটতেই পারেন। রাস্তা কারও একার নয়।
[আরও পড়ুন: পুতিনের ‘মধুসূদন দাদা’ এখন জিনপিং! কেন চিনকে ‘সোনার তরী’ ভাবছে রাশিয়া]
এখন প্রশ্ন হল বহরমপুরের 'রবিনহুড' কী সেই পথেই হাঁটবেন? নাকি দলের কর্তাব্যক্তিদের কথা শুনে লাইনে আসবেন? এতদিন বিজেপিতে যোগের ক্ষেত্রে অধীরের যে মূল বাধাটা ছিল, সেটা হল সংখ্যালঘু ভোট। মুর্শিদাবাদে বিজেপির হয়ে রাজনীতি করাটা কঠিন। কিন্তু এই মিথ গত বিধানসভা নির্বাচনে ভেঙে গিয়েছে। মুর্শিদাবাদের অধিকাংশ বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপি দ্বিতীয় হয়েছে। দুটি জিতেছে।
তাছাড়া যে সংখ্যালঘু ভোট অধীরের রাজনৈতিক জীবনের মূল পুঁজি ছিল, সেটার সিংহভাগই এখন তৃণমূলের দখলে। তাছাড়া সাধের কংগ্রেস দলই যখন তাঁর রাজনৈতিক লাইনকে সমর্থন করছে না, সেখানে কীসের ভরসাতেই বা পড়ে থাকবেন তিনি? তাছাড়া কংগ্রেসের এমন শক্তিও নেই যে সেখানে থাকলে রাজনৈতিকভাবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব কোণঠাসা অধীরের জন্য বিজেপি মন্দ বিকল্প নয়! এখন দেখার, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তুলনামূলক সহজ বিজেপির রাস্তা নেন, নাকি কণ্টকময় কংগ্রেসের পথেই মুখ বুজে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন? দ্বিতীয়টি করতে পারলে অবশ্যই আদর্শগত আনুগত্যের জন্য মহানতার দাবি করতেই পারেন বহরমপুরের সামন্তরাজা।