সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: দশ বছর-কুড়ি বছর নয়। ৪৭ বছর অর্থাৎ প্রায় পাঁচ দশক পর জঙ্গলমহল পুরুলিয়ায় ছোট-ছোট সভায় সিপিএম বলছে, সিংহ ছাপে ভোট দেবেন না। বামফ্রন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাত চিহ্নে ভোট দিন।
পুরুলিয়া লোকসভা আসনে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের সমঝোতা হলেও শরিক দল ফরওয়ার্ড ব্লককে নিয়ে এহেন মন্তব্যে জঙ্গলমহলে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। এই জেলায় ফরওয়ার্ড ব্লকের একদা ঘাঁটি বলতে যা বোঝায় সেই বাঘমুন্ডি, ঝালদা, কোটশিলা, জয়পুর, আড়শার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে প্রান্তিক মানুষজন যারা লোকসভা ভোট মানে সিংহ ছাপকেই বুঝতেন। বুঝতেন চিত্ত মাহাতোর নাম। বুঝতেন বীর সিং মাহাতোর নাম। সিপিএমের কাছ থেকে যখন এই বার্তা তারা পাচ্ছেন, অবাক হয়ে যাচ্ছেন। তারা জানেন না, সিপিএমের সঙ্গে এই আসন সমঝোতার কথা। জানেন লোকসভা ভোট মানেই সিংহ ছাপে ভোট দেওয়া। তারা যে সকলেই কট্টর ফরওয়ার্ড ব্লক তা কিন্তু নয়। অনেকে সিপিএমের ঝান্ডা ধরে আজও রয়েছেন। তৃণমূলের ভরা বাজারেও বামফ্রন্টের ভাবধারা থেকে বেরিয়ে আসেননি। ফলে ফরওয়ার্ড ব্লককে অর্থাৎ সিংহ ছাপে ভোট নয়। সিপিএমের এই প্রচারে জেলার প্রান্তিক মানুষজনের অবাক হয়ে যাওয়ার বিষয়টি দলের অভ্যন্তরে রিপোর্ট হয়েছে। তার পরেও কমরেডদের একই প্রচার। বৃহত্তর স্বার্থে পুরুলিয়ায় কংগ্রেসের 'হাত' শক্ত করতে হবে।
[আরও পড়ুন: ‘সাত দফায় সাত অঙ্গ ভাঙব বিজেপির’, দার্জিলিংয়ে হুঁশিয়ারি অভিষেকের]
সম্প্রতি ঝালদার একটি স্কুলে সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ কর্মীসভায় সিপিআইএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্র (Amiyo Patra) সরাসরি বলেন, "সিংহ ছাপে ভোট দেবেন না।" এ বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, "বামফ্রন্টের সিদ্ধান্ত শরিক দলকে মান্যতা দিতে হবে। ২টি শরিক দল মান্যতা দিচ্ছে। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক তা করছে না। মানুষের মধ্যে যাতে কোনরকম বিভ্রান্তি না ছড়ায় সেই কারণেই আমরা বামফ্রন্টের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছি। ভোটটা সিংহ ছাপে দেবেন না। ভোটটা হাত চিহ্নে দেবেন। " তাঁর কথায়, "দেশে একটা বড় বিপদ এসেছে। সেখানে বামফ্রন্ট একা লড়ে সামলাতে পারবে না। অন্য দলগুলো পারবে না। তাই এই দলগুলো মনে করছে, সবার কাছাকাছি আসা উচিত। সেই কারণেই কাছাকাছি এসেছে। না হলে বিজেপি দেশটাকে ধ্বংস করে দেবে।" ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রতি তাঁর কটাক্ষ, "বামফ্রন্ট একটা যৌথ পরিবার। যেখানে বাবা-মা পাঁচ ছেলে রয়েছেন। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক সেটা বুঝতে পারছে না। বামফ্রন্টের নীতি অনুযায়ী এই সিটে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত নয়।" সিপিএমের কথায়, এই আসনে বামফ্রন্ট মনোনীত চিত্ত মাহাতো লড়তেন। তাঁরা আহ্বান করতেন সিংহ ছাপে ভোট দিতে। তারপর বীর সিং মাহাতোকেও সিংহ ছাপে ভোট দেওয়ার কথা বলতেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুরুলিয়া আসনে তাঁরা হাত চিহ্নে ভোট দেওয়ার কথা বলছেন।
[আরও পড়ুন: ‘সাত দফায় সাত অঙ্গ ভাঙব বিজেপির’, দার্জিলিংয়ে হুঁশিয়ারি অভিষেকের]
সিপিএমের এই ভোট প্রচারের পাল্টা দিয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক। ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য অসীম সিনহা বলেন, "কংগ্রেসের সঙ্গে নতুন প্রেম সিপিএমের। তাঁরা একেবারে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসকে জড়িয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। কংগ্রেসের পা ধরে এমপি হওয়ার চেষ্টা করছে। ২০২১-র বিধানসভায় বাঘমুন্ডি আসনে কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু জেতাতে পারেনি। এবারও জেতাতে পারবে না।" ফরওয়ার্ড ব্লক সিপিএমকে মনে করিয়ে দিয়েছে, "১৯৭১ সালে পুরুলিয়া আসনে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী দেয়। তখন বামফ্রন্ট হয়নিl তার পরেও সিপিএম দয়া করে এই আসন ছাড়েনি। ১৯৭৭ সালে পুরুলিয়া আসন জনতা পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল বামফ্রন্ট। জনতা পার্টির তরফে দ্বিজেন সেনগুপ্তকে প্রার্থী করা হয়। কিন্তু তারা ওই আসন থেকে সরে আসেন। তারা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেসকে হারাতে পারবে। তারপর ৭৭ সাল থেকে উপনির্বাচন মিলিয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ফরওয়ার্ড ব্লকের সাংসদ ছিল পুরুলিয়া কেন্দ্রে। অর্থাৎ, ১১ বার এই আসনে ফরওয়ার্ড ব্লক জয়ী হয়। ফরওয়ার্ড ব্লকের কথায়, সেই ইতিহাসকে সামনে রেখেই পুরুলিয়া কেন্দ্রে ধীরেন্দ্রনাথ মাহাতোকে প্রার্থী করা হয়েছেl দলের রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য অসীম সিনহা বলেন, "আমরা এই ইতিহাসের কথা বলায় সিপিএম কটাক্ষ করছেl কিন্তু সিপিএমকে আমরা বলতে চাই ফরওয়ার্ড ব্লক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিল। যারা আজ কংগ্রেসকে সমর্থন করছেন তারা আগামী দিনে ইতিহাসের পাতায় চলে যাবেন। ফরওয়ার্ড ব্লককে কিন্তু কেউ কোনওদিন শেষ করতে পারবে না।"