টিটুন মল্লিক, বাঁকুড়া: কংসাবতী, দামোদর এবং দ্বারকেশ্বরের মতো নদ-নদী দিয়ে চারদিকে ঘেরা রাঙামাটির জেলা বাঁকুড়া। জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে গভীর জঙ্গল। জেলার কোনায় কোনায় অনুন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট। একসময় এই অনুন্নয়নকে হাতিয়ার করে মাওবাদীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। জেলার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল বারুদের গন্ধ। তবে সে সবকিছুই আজ অতীত। এখন রাজনীতির অন্যতম নজরকাড়া কেন্দ্র বাঁকুড়া।
ইতিহাস
জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। পুরসভা এলাকাও রয়েছে। একদা মল্লরাজাদের রাজধানী বিষ্ণুপুরের ইতিহাস বহু প্রাচীন। জড়িয়ে রয়েছে মল্ল রাজবংশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। ১৯৫১ সালে এই লোকসভা কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত। ১৯৫০ সালে নির্বাচনী কোটা কার্যকর হওয়ার পর এ জেলা থেকে একাধিক তফসিলি জাতি এবং উপজাতির নেতা উঠে এসেছেন। এর আর্থ সামাজিক প্রভাবও পড়েছে। এই লোকসভা কেন্দ্রে বসবাসকারী বেশীরভাগ ভোটার কৃষিজিবী, অসংগঠিত শ্রমিক। বর্ষার বৃষ্টির উপর এজেলায় নির্ভর করে কৃষিকাজ। ডোকরা,টেরাকোটা এবং হস্তচালিত তাঁত শিল্পের মতো কুটিরশিল্পের সঙ্গে জড়িত বহু মানুষ। এছাড়া এজেলার মেজিয়া এবং শতালতোড়া মতো খনি অঞ্চলও রয়েছে। যেখানে কয়লা উত্তোলন, পাথর খাদানে কাজ করেন বহু মানুষ। হাতেগোলা কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা রয়েছে ঠিকই। তবে সেগুলি ধুঁকছে, প্রায় বন্ধের মুখে। বাড়িতে -বাড়িতে গরু. ছাগলের মতো গবাদি পশুপালন কিছুটা ভরসা জোগায় গরিবগুর্বো পরিবারগুলিকে। গত রাজ্য বাজেটে রঘুনাথপুরে জঙ্গলসুন্দরী কর্মনগরী গড়ে তোলার কথা ঘোষণা হয়েছে। রঘুনাথপুর মহকুমার নিতুড়িয়া , রঘুনাথপুর ১ ও ২ নম্বর এলাকায় রাজ্য শিল্প উন্নয়ন ৩ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো তিনটি বড় শিল্প সংস্থাকে জমি দেওয়া হয়েছিল। শিল্পের জন্য জল, কাঁচামাল, যোগাযোগের সব ব্যবস্থাই রয়েছে। তবে এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ আসেনি এই এলাকায়।
[আরও পড়ুন: বাংলায় ৭ দফায় নির্বাচন, কোন লোকসভা কেন্দ্রে কবে ভোট? রইল পূর্ণাঙ্গ তালিকা]
এলাকার জনবিন্যাস
২০১১ সালের শেষ জনগণনা অনুযায়ী, বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রে জাতভিত্তিক জনসংখ্যার বৌদ্ধ ০.০১ শতাংশ, খ্রিস্টান ০.১৪ শতাংশ , জৈন ০.০৯ শতাংশ, মুসলিম ৪.৯ শতাংশ, তফসিলি ২৯.১ শতাংশ, তফসিলি উপজাতি ১৭ শতাংশ, শিখ ০.০২ শতাংশ। ভোটার তালিকা অনুযায়ী জাত বা উপাধি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায়, বাউরি জাতি ১০.৬ শতাংশ, মণ্ডল ৬.৯ শতাংশ, মুসলিম ৪.৯ শতাংশ, রয় ৩.৪ শতাংশ, মাহাতো ৩.৪ শতাংশ, মাঞ্জি ২.৭ শতাংশ, ডি এ এস ২.৬ শতাংশ, মুর্মু ২.৫ শতাংশ, সোরেন ১.৮ শতাংশ, মান্ডি ১.৮ শতাংশ, ঘোষ ১.৮ শতাংশ, কর্মকার ১.৮ শতাংশ, পল ১.৭ শতাংশ, সর্দার ১.৬ শতাংশ হেমব্রম ১.৬ শতাংশ, হাঁসদা ১.৬ শতাংশ, টুডু ১.৬ শতাংশ, পাত্র ১.৫ শতাংশ, গরাই ১.৫ শতাংশ, লোহার ১.৩ শতাংশ, মাল ১.২ শতাংশ, দত্ত ১.১ শতাংশ প্রামাণিক ১ শতাংশ, দুলে ১ শতাংশ, কুন্ডু ০.৯ শতাংশ, মুখার্জী ০.৮ শতাংশ, চক্রবর্তী ০.৭ শতাংশ, সিং ০.৭ শতাংশ।
বিধানসভা কেন্দ্রগুলি
বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৭ কেন্দ্র- বাঁকুড়া, ছাতনা, শালতোড়া, রানিবাঁধ, রায়পুর, তালডাংরা আর পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর। পুরসভা ২টি- বাঁকুড়া আর রঘুনাথপুর পুরসভা। এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত খাতড়া মহকুমার খাতড়া শহরকে পুরসভা করার দাবি দীর্ঘদিনের। সেই দাবি আজও অধরা।
রাজনৈতিক চিত্র
বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রটি এককালে বামেদের দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে পরিচিত ছিল। ১৯৮০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটানা এই লোকসভা কেন্দ্রটি থেকে সংসদে গিয়েছেন বামপ্রার্থী বাসুদেব আচারিয়া। তবে ২০১৪ সালে তৃণমূল প্রার্থী অভিনেত্রী মুনমুন সেনের কাছে হেরে যান প্রবীন ওই বামপ্রার্থী। ২০১৯ সালে এই কেন্দ্রে আর মুনমুন সেনকে প্রার্থী করেনি ঘাসফুল শিবির। কেন্দ্রটিতে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে তৃণমূল প্রার্থী করে কলকাতার সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকারের কাছে হেরে যান তিনি। তার পর থেকে এই এলাকায় ক্রমেই একের পর এক বিধানসভা কেন্দ্রে ফুটতে শুরু করে পদ্মফুল। বর্তমানে লড়াইটা বিজেপি বনাম তৃণমূলের লড়াই।
বিগত নির্বাচনের ফলাফল
২০১৪ সালে তৃণমূলের মুনমুন সেন ভোট পেয়েছিলেন ৪ লক্ষ ৮২ হাজার ৯১১টি। সেখানে বামপ্রার্থী বাসুদেব আচারিয়া ভোট পেয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪০০। বিজেপি প্রার্থী সুভাষ সরকার ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ২ লক্ষ ৫০ হাজার ৮৫৩টি। ২০১৯ সালে তৃণমূল প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ভোট পেয়েছিলেন ৫ লক্ষ ১২২। সুভাষ সরকার ভোট পান ৬ লক্ষ ৭২ হাজার ২০২। এবং বামেদের ভোট কমে গিয়ে বামপ্রার্থী অমিয় পাত্র ভোট পান মাত্র ১ লক্ষ ১৪টি। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বাঁকুড়া, ছাতনা, রঘুনাথপুর, এবং শালতোড়ার মতো বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে জয়ী হয় বিজেপি। বাকি তিনটি বিধানসভা জঙ্গলমহলের রানিবাঁধ , রাইপুর এবং তালডাংরায় নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে সফল হয় তৃণমূল।
[আরও পড়ুন: প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার পরিস্থিতি কেমন? চিনের মোকাবিলায় কতটা তৈরি ফৌজ? জানালেন সেনাপ্রধান]
কেন্দ্রের প্রার্থী
বামেরা প্রার্থী করেছে আইনজীবী নীলাঞ্জন দাশগুপ্তকে। তৃণমূলের প্রার্থী প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি এবং তালডাংরার বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তী। বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা সাংসদ সুভাষ সরকার।
রাজনৈতিক সমীকরণ
পর পর দুবার ‘বহিরাগত’কে প্রার্থী করার পর এবার বাঁকুড়ার ভূমিপুত্রকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। দলের অন্দরের বহিরাগত প্রার্থীদের নিয়ে ক্ষোভ ছিল। কেউ কেউ সেই রাগেই নির্বাচনের কাজ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। এবার সেই দ্বন্দ্ব নেই। প্রার্থী হিসেবে জেলা সভাধিপতি তথা বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তী হাতের তালুর মতো চেনেন সাত বিধানসভা। জঙ্গলমহলে দীর্ঘদিন ধরে দলীয় সংগঠন করেছেন তিনি। রঘুনাথপুরের বাসিন্দা হওয়ায় এলাকায় অরূপ চক্রবর্তীর জনপ্রিয়তাও রয়েছে।
উলটোদিকে সাতটি বিধানসভার কোথাও বিজেপির সংগঠন তেমন মজবুত নয়। মাত্র কয়েকটি পকেটে গেরুয়া শিবিরের অস্তিত্ব রয়েছে। বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকার এখনও কর্মীদের প্রচারে নামাতে পারেননি। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে দলেরই একাংশ। সোশাল মিডিয়ায় সুভাষ সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতর প্রচার চলছে। সূত্রের খবর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নির্দল কাঁটায় পড়তে হতে পারে। তাঁর বিরুদ্ধে জীবন চক্রবর্তী নামে প্রার্থী দাঁড়াতে পারেন। বামেদের প্রার্থী অত্যন্ত দুর্বল। ফলে বাম ভোট ফের রামে যাওয়ার আশঙ্কা। তবে জেলায় বিজেপির হাওয়া রয়েছে। জেলার বাসিন্দাদের মধ্যে একটা বড় অংশ মনে করে, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’। একমাত্র মোদি ঢেউয়েই বাঁকুড়ায় ফুটতে পারে পদ্ম।