জ্যোতি চক্রবর্তী: নদিয়ার দুটি ও উত্তর ২৪ পরগনার পাঁচটি বিধানসভা নিয়ে তৈরি বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র। বনগাঁ মহকুমা জুড়ে রয়েছে সীমান্ত এলাকা। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কোথাও কোথাও কাঁটাতার আছে, কোথাও কাঁটাতার নেই। এই লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেই রয়েছে পেট্রাপোল সীমান্ত। দৈনিক কয়েকশো ট্রাক প্রচুর পণ্য নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে যায়। মহকুমার বহু মানুষের রুটিরুজি পেট্রাপোল বন্দর কেন্দ্রিক।
বনগাঁয় বড় কোনও শিল্প কারখানা নেই। কিছু চিরুনি কারখানা রয়েছে। যশোরের চিরুনি হিসেবে বনগাঁ চিরুনির খ্যাতি ছিল দেশজুড়ে। অতীতে সুনাম থাকলেও এখন তা ধুঁকছে। বনগাঁর অর্থনীতি সিংহভাগ পরিবহণ ব্যবসা নির্ভর। এছাড়াও সীমান্তে চোরাচালানোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বহু মানুষ যুক্ত। চোরাচালানকে এখানে ক্ষুদ্রশিল্প হিসেবে ধরা হয়! বহু মানুষ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। রয়েছে কিছু ইটভাটাও।
গত বিধানসভা ভোটে বনগাঁ লোকসভার অন্তর্গত স্বরূপনগর বাদ দিয়ে ছটি বিধানসভাতেই বিজেপি প্রার্থীরা জয়লাভ করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে লোকসভা নির্বাচনের আগে কিছুটা হলেও এগিয়ে থেকে শুরু করছে পদ্ম শিবির। বনগাঁ লোকসভা আসনটিও বিজেপির দখলে।
এই লোকসভা কেন্দ্রে অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রগুলি হল-
- কল্যাণী
- হরিণঘাটা
- বনগাঁ
- উত্তর বনগাঁ
- দক্ষিণ গাইঘাটা
- বাগদা
- স্বরূপনগর
[আরও পড়ুন: মধ্যপ্রদেশে খতম শীর্ষ নেত্রী ক্রান্তি, ছত্তিশগড়ে এনকাউন্টারে নিহত ৮ মাওবাদী]
জনবিন্যাস
লোকসভা কেন্দ্রের ৬০ শতাংশের বেশি ভোটার তফসিলি সম্প্রদায়ের। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটার। প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ ভোটার মতুয়া সমাজের অন্তর্ভুক্ত। ওপার বাংলা থেকে আসা প্রচুর মতুয়া ও উদ্বাস্তুরা এখানে বাস করেন। তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল নাগরিকত্ব। সম্প্রতি কেন্দ্র সরকার নাগরিক সংশোধিত আইন তথা সিএএ কার্যকর করার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে | কিন্তু মতুয়াদের একাংশ সিএএ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তাঁদের দাবি সিএএ তে আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব চান। আবেদনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব চান না। স্বাভাবিকভাবে এবারের ভোটে এই নাগরিকত্ব বিষয়টি বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে।
ইতিহাস
২০০৯ সালের আগে বনগাঁ লোকসভা আসনটি বারাসত লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল। ২০০৯ সালে বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্র হয়। ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে বনগাঁর লোকসভার আসনে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থীরা। ২০০৯ সালে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের গোবিন্দচন্দ্র নস্কর। ২০১৪ সালে জয়ী হোন তৃণমূলের কপিল কৃষ্ণ ঠাকুর। জয়ী হওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালের উপনির্বাচনে তাঁর স্ত্রী মমতাবালা ঠাকুর জয়ী হয়ে সাংসদ হন। ২০১৯ সালে ইতিহাস বদলায়। জয়ী হন বিজেপির শান্তনু ঠাকুর। ২০১৯ সালের আগে বনগাঁ লোকসভা আসনটি তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১৯ সালের পর থেকে তৃণমূল ক্রমশ শক্তি হারাতে শুরু করে। ২০২১ এর বিধানসভা ভোটেও তারা পর্যদুস্ত হয়। ২০১১ সালের পর থেকে সিপিএম তথা বামেদের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। যা এখনও অব্যাহত।
প্রার্থী পরিচয়
তৃণমূল ও বিজেপি ইতিমধ্যে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে। বিজেপির প্রার্থী বিদায়ী সংসদ শান্তনু ঠাকুর। তৃণমূল প্রার্থী বাগদার বিধায়ক তথা তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস। এখনও পর্যন্ত কংগ্রেস বা বামেরা কোনও প্রার্থী ঘোষণা করেনি | শোনা যাচ্ছে বামেরা এই আসনটি কংগ্রেসকে ছাড়তে চলেছে। কিন্তু কবে বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হবে কবেই বা প্রার্থী ঘোষণা হবে তা নিশ্চিতভাবে কেউই বলতে পারছে না।
[আরও পড়ুন: নগদ ২১ লক্ষ, ফরচুনার গাড়ি, কিছুই দেয়নি শ্বশুরবাড়ি, রাগে স্ত্রীকে পিটিয়ে খুন স্বামীর!]
হালফিলের হকিকত
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে একমাত্র স্বরূপনগর বিধানসভা ছাড়া বাকি ৬ টি বিধানসভায় এগিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সেই স্বরূপনগরেই একমাত্র তৃণমূল প্রার্থী বিনা মণ্ডল জয়লাভ করেন। বাকি ৬টি আসনে জয়ী হন বিজেপি প্রার্থীরা। বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন বিশ্বজিৎ দাস। ভোটে জিতে অবশ্য তিনি তৃণমূলে যোগদান করেন। তাঁকে তৃণমূলের জেলা সভাপতিও করা হয়। তাঁকেই এবার তৃণমূল প্রার্থী করেছে।
গত পুরসভা ভোটে অবশ্য তৃণমূল ভালো ফল করেছে। বনগাঁ এবং গোবরডাঙ্গা পুরসভা দুটিতেই তৃণমূল জয়লাভ করেছে। পঞ্চায়েত ভোটেও তৃণমূলের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে। বনগাঁ মহকুমার ৯টি জেলা পরিষদের আসনের সব কটিতে জয়ী হয়েছে তৃণমূল | ৭টি পঞ্চায়েত সমিতির সবকটি দখল করেছে তৃণমূল। ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত ছাড়া ৫৪ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে সবকটিতেই তৃণমূল জয় লাভ করে। যদিও বিরোধীদের অভিযোগ ছিল পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদল ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়েছে। ফলে মানুষের প্রকৃত রায়ের প্রতিফলন ঘটেনি |
২০১১ সালের পর থেকে সিপিএম কার্যত এখানে ধুয়ে মুছে গিয়েছে। গত পুরসভা ভোটে একটি ওয়ার্ডেও তারা জয় লাভ করতে পারেনি। কোন পঞ্চায়েতেও তারা ক্ষমতায় আসতে পারেনি। মানুষের সঙ্গে জনবিচ্ছিন্নতা ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণই এর কারণ।
সম্ভাবনা
২০১৯ সাল থেকেই বনগাঁ লোকসভা এলাকায় বিজেপির বাড়বাড়ন্ত। বিধানসভা ভোটেও তা অব্যাহত ছিল। যদিও পঞ্চায়েত এবং পুরসভা ভোটে পদ্মশিবির ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু বনগাঁ লোকসভা এলাকায় অসংখ্য উদ্বাস্তু এবং মতুয়া সমাজের মানুষ বসবাস করেন। তাঁদের বড় অংশের সমর্থন উনিশ সাল থেকে বিজেপির দিকে থাকায় তাদের এই সাফল্য বলে রাজনৈতিক মহল মনে করে।
সিএএ কার্যকর করা নিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি একে অপরের বিরুদ্ধে পালটা প্রচার শুরু করেছে। মতুয়াদের একটা বড় অংশ রাস্তায় নেমে সিএএ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। এখানেই আশার আলো দেখছে তৃণমূল শিবির। শেষপর্যন্ত এই মতুয়াদের উপরই নির্ভর করছে তৃণমূল বা বিজেপির জয়-পরাজয়। এই লোকসভা এলাকায় সংখ্যালঘু ভোট খুব বেশি নেই। ফলে সংখ্যালঘু ভোট খুব বেশি ফ্যাক্টর নয় | যদিও সিএএ আইনে যে ছটি ধর্মের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে ইসলাম ধর্ম নেই। ফলে ১৯৭১ সালের পরে যে সমস্ত মুসলিমরা এদেশে এসেছেন তাঁরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তাদেরও বড় অংশের সমর্থন তৃণমূলের দিকে থাকছে।