সুমন করাতি, হুগলি: হুগলি নদীর পাশে গড়ে উঠেছিল একের পর এক চটকল। মেশিনের ঘড়ঘড় আওয়াজ, দুবেলা কয়েক হাজার মানুষের আনাগোনা। এটাই পরিচিত ছবি ছিল হুগলি শিল্পাঞ্চলের। কিন্তু বদলেছে সেই ছবি। তালা ঝুলেছে একের পর এক চটকলে। শুধু চটকল নয়, এক সময় হুগলির প্রাণভোমরা ছিল হিন্দুস্তান মোটরসও। তারাও ঝাঁপ ফেলেছে প্রায় দেড় দশক হল। তার পর হুগলি নদী দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। কয়েকটি টিমটিম করে জ্বলতে থাকা চটকল আর কিছু চাষবাসের উপর ভরসা করেই দাঁড়িয়ে রয়েছে হুগলির অর্থনীতি। এই জেলার অন্তর্গত ঐতিহ্যপূর্ণ লোকসভা কেন্দ্র শ্রীরামপুর। রয়েছে মাহেশের জগন্নাথ মন্দির। আবার ফুরফুর শরিফও এই কেন্দ্রের অন্তর্গত।
স্বাধীনতার পর থেকে শ্রীরামপুর লোকসভা আসনে একছত্র প্রভাব ছিল বামপন্থীদের। বাংলায় নতুন শক্তি হিসেবে তৃণমূল উঠে আসায় বামপন্থীদের শক্তি ক্রমশ ক্ষয় হতে হতে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। আবার ২০০৯-এর পর থেকে এখানে দক্ষিণপন্থী শক্তি বিজেপির রমরমাও বেড়েছে।
লোকসভার অন্তর্গত বিধানসভা
হুগলি জেলার পাঁচটি ও হাওড়ার ২টি বিধানসভা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই লোকসভা কেন্দ্র।
- শ্রীরামপুর
- চাপদানী
- উত্তর পাড়া
- চন্ডীতলা
- জাঙ্গিপাড়া
- ডোমজুড় (হাওড়া)
- জগৎবল্লভপুর (হাওড়া)
[আরও পড়ুন: ‘ওদের ৬০ জায়গার নাম বদলে দেওয়া উচিত’, চিনকে যোগ্য জবাব দেওয়ার দাবি হিমন্তর]
জনবিন্যাস
এই কেন্দ্রের অধিকাংশই হিন্দু ভোটার। তবে এই কেন্দ্রে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে সংখ্যালঘু ভোটাররা। কারণ সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। দুটি বিধানসভায় প্রচুর সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছেন। চণ্ডিতলা বিধানসভার কিছুটা এবং জাঙ্গিপাড়া বিধানসভার পুরোটাই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত।
ইতিহাস
১৯৫২ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে এই শ্রীরামপুর আসনটি জিতেছিলেন সিপিএম প্রার্থী তুষার চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে হারিয়ে ১৯৫৭-র নির্বাচনে এই আসনে জেতেন কংগ্রেস প্রার্থী বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী জিতেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। ১৯৬২ সালে ফের জয়ে ফেরে বামেরা। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস প্রার্থী জয়লাভ করলে ১৯৭১ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত আসনটি নিজেদের দখলে রেখেছিল বামেরা। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হন কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে অধ্যাপক বিমলকান্তি ঘোষ। ১৯৮৯ এবং ১৯৯১ -এর ভোটে জয় পেয়েছিলেন সুদর্শন রায় চৌধুরী। মাঝে ১৯৯৬ সালে জেতেন কংগ্রেস প্রার্থী। বাম-কংগ্রেসের এই 'লুপ' কেটে ১৯৯৮ সালে জেতেন তৃণমূলের আকবর আলি খন্দকার। ২০০৪ সালে ফের বামেরা জেতেন। কিন্তু ২০০৯ সালে পাশা বদলে যায়। ২০০৯, ২০১৪, ২০১৯ সালে পর পর তিনবার শ্রীরামপুরের সাংসদ নির্বাচিত হন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্য়ায়। এবারও তাঁকেই প্রার্থী করেছে তৃণমূল।
হালফিলের হকিকত
২০০৯ সাল থেকেই এই লোকসভায় ঘাসফুলের জয়জয়কার। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতে একচেটিয়া দাপট দেখিয়েছিল তৃণমূল। যদিও বিরোধীদের অভিযোগ, ভোট করতে দেওয়া হয়নি। ভোট লুট করেছিল তৃণমূল। একুশের বিধায়সভা ভোটে হুগলির ৫টি ও হাওড়ার দুটি বিধানসভা দখল করে রাজ্যের শাসকদল। পুর ও পঞ্চায়েত ভোটেও দাঁত ফোটাতে ব্যর্থ বিরোধীরা। কোন্ননগর, রিষড়া, শ্রীরামপুর, চাপদানি, ভদ্রেশ্বর, ডানকুনি পুরসভাও ঘাসফুলের দখলে। সব পঞ্চায়েতও জিতেছিল তৃণমূল। তবে তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রথমবার রিষড়া পঞ্চায়েত তিনটি আসন জিতেছিল আইএসএফ। তবে ফুরফুরা পঞ্চায়েতেও আব্বাস-নওশাদরা দাঁত ফোটাতে পারেননি।
আরও পড়ুন: ছাগলের সঙ্গে অভিনেতা পৃথ্বীরাজের অন্তরঙ্গ দৃশ্য! কী বললেন ‘আদুজিবীথাম’ ছবির পরিচালক?]
প্রার্থী পরিচয়
চতুর্থবারের জন্য সাংসদ হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএম এই আসনে প্রার্থী করেছে প্রাক্তন মন্ত্রী পদ্মনীধি ধরের নাতনি তথা জেএনইউর প্রাক্তনী দীপ্সিতা ধরকে। আবার কল্যাণবাবুর প্রাক্তন জামাই কবীরশংকর বসুকে প্রার্থীপদ দিয়েছে বিজেপি। এই কেন্দ্রে আইএসএফ প্রার্থী দিলেও তাঁর দেখা নেই। প্রচারেও নেই তিনি। ফলে মনোনয়ন দেবেন কি না তাও এখনও স্পষ্ট নয়।
সম্ভাবনা
শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে জোরদার তৃণমূলের হাওয়া। তিনবারের জয়ী সাংসদ এবং তৃণমূলের যুব-ছাত্র ও মহিলা সংগঠনের উপর ভর করে হাসতে হাসতে লোকসভা ভোটের বৈতরণী পার করতে পারে ঘাসফুল শিবির, বলছে রাজনৈতিক মহল। তবে দলীয় কর্মীদের প্রতি কল্যাণের ব্যবহার নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। ফলে কল্যাণ বিরোধী গোষ্ঠী বেশ সক্রিয়। অন্যদিকে বিজেপি প্রার্থীকে নিয়ে দলের অন্দরেই ক্ষোভ রয়েছে। নির্বাচনের সময় ছাড়া কবীরশংকর বসুকে এলাকায় দেখা যায় না বলেই অভিযোগ। নিজস্ব পরিচয়ের বাইরে বিজেপি প্রার্থী ভোটপাখি। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাক্তন জামাই হিসেবেই বেশি পরিচিত তিনি। বিজেপির প্রার্থী ভালো হলে লড়াইটা জমজমাট হত। কিন্তু তা না হওয়ায় এই কেন্দ্রে ফ্যাক্টর সিপিএম। তাঁর প্রচারে প্রচুর যুব মুখের দেখা মিলছে। দীপ্সিতার প্রচারে মূল ইস্যু হচ্ছে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি, যা জনমানসে দাগ কাটছে। এদিকে এলাকায় সংখ্যালঘু ভোট বড় ফ্যাক্টর। সেই ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসাতে পারে আইএসএফ। সেক্ষেত্রে কল্যাণের জয়ের ব্যবধান কমতে পারে। তবে আইএসএফ প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন কি না তা এখনও নিশ্চিত নয়।