রূপায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: গায়ে জামা, পরনে সাদা লুঙ্গি। মাথায় পাগড়ির মতো পেঁচানো গামছা। কাঁধে রাইফেল ঝোলানো লোকগুলোকে দেখলে আম আদমির গলা শুকিয়ে যায়। ওরা জলদস্যু। ঝাড়খণ্ডের ‘জলদস্যু’। মালদহের ঝাড়খণ্ড সীমান্তে যাদের অন্য নাম ‘ঠিয়া পার্টি’।
চারদিক গঙ্গা দিয়ে ঘেরা মালদহের(Maldah) গদাইচর, নারায়ণপুর চরের কয়েকশো কৃষক আপাতত এই ঠিয়া পার্টির দৌরাত্ম্যে নাওয়া-খাওয়া-ঘুম ভুলেছেন। গঙ্গা নদীবক্ষে গজিয়ে ওঠা চরে চড়াও হয়ে বাংলায় চাষিদের ফসল লুঠ করছে পড়শি রাজ্যের দস্যুদল। যন্ত্রচালিত নৌকা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নদীবক্ষে লুঠপাট চালাতেও কসুর নেই। কখনও বাইকে চেপেও এসে চরে হামলা চালায়। মানিকচক, রতুয়া তল্লাটের বাতাসে কান পাতলে ভোটের দামামার আড়ালে শোনা যাচ্ছে ‘ঠিয়া পার্টি’র কথা। চর্চায় উঠে আসছে ঝাড়খণ্ডের জলদস্যুদের অত্যাচারের হরেক কাহিনি।
[আরও পড়ুন: ‘গুণ্ডাদের উলটো ঝোলাব, খুলে যাবে বন্ধ কারখানা’, দিলীপ জিতলে কেমন হবে দুর্গাপুর? জানালেন শাহ]
শোনা যায়, সাত-আটের দশক থেকে এই দস্যুরা মানিকচক ব্লকের গদাইচর, ভূতনির চরের বাসিন্দাদের ত্রাসে পরিণত হয়েছিল। তৎকালীন বিহার থেকে নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে যখন তখন গ্রামে ঢুকে গুলি—বোমা ছুড়ে লুঠপাট চালিয়ে তারা ফিরে যেত। আর লুঠপাটে বাধা দিলে ঠিয়ার উপরে রেখে মাংস কাটার কায়দায় বাসিন্দাদেরও টুকরো টুকরো করে নাকি কেটে ফেলত। যে গাছের গুঁড়ির উপর মাংস কাটা হয়, স্থানীয় ভাষায় তাকে ‘ঠিয়া’ বলা হয়ে থাকে। সেই কারণেই ওই দস্যুদলকে এখনও 'ঠিয়া পার্টি' বলে ডাকা হয়। এমন কথাও প্রচলিত আছে, সেই সময় ওইসব এলাকায় রাতে সন্তানদের মায়েরা ঘুম পাড়াত এই 'ঠিয়া পার্টি'র কথা বলেই। ২০১৬ সালে ভুতনিতে থানা চালু হয়। গঙ্গার এপারে মহানন্দা টোলায় পুলিশ ফাঁড়িও হয়েছে। গঙ্গাবক্ষে পুলিশের টহলদারি লঞ্চও যায়। এখন গ্রামের মধ্যে সেই হানাদারি প্রায় নেই। কিন্তু গঙ্গায় ওপারে গজিয়ে ওঠা চরে ও নদীবক্ষে এখনও ঠিয়া পার্টির লুঠপাট চলছে বলেই অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
মহানন্দা টোলার বাসিন্দা বিশ্বজিৎ ধাওয়ালের অভিযোগ, "গঙ্গা এগিয়ে আসায় ওপারের চরে আমাদের জমি জেগে উঠেছে। সেখানে ফসল ফলালেই লুঠপাট চালায় 'ঠিয়া পার্টি'। ভাগ দিতে হয় ফসলের। কলাই চাষ করি। কলাই দামি। ফসল কাটতে গেলেই বন্দুক নিয়ে চলে আসে ওরা।" রতুয়ার পাশাপাশি মোথাবাড়ি, বৈষ্ণবনগর, মানিকচক এই সব বিধানসভা এলাকাও ভাঙনের কবলে। মহানন্দা টোলা থেকে আগে গঙ্গার দূরত্ব ছিল ১৯ কিলোমিটার। সেই দূরত্ব কমে এখন হয়েছে তিনশো মিটার।
[আরও পড়ুন: সন্দেশখালি ‘স্টিং’ বিতর্কে মহুয়া গড়ে মুখ খুললেন শাহ, ‘ডিপফেক’, দাবি শুভেন্দুর]
সেই সাতের দশক থেকেই মালদহ জেলা গঙ্গার বিষ নজরে। জেলার পাঁচটি ব্লক ভাঙন কবলিত। আর গঙ্গা এগিয়ে এসে এপারের জমি গ্রাস করে নিয়েছে। গঙ্গার অপর পাড়ে যে চর জেগে উঠেছে, সেখানে এদিকের গ্রামবাসীরা ফসল ফলাচ্ছে। ধান—পাট—গম—ভুট্টার চাষ হচ্ছে। এপার থেকে দশ টাকা করে ভাড়া দিয়ে নৌকা করে গঙ্গা পেরিয়ে ওপারের চরে যাতায়াত করতে হয় গ্রামবাসীদের। এক গ্রামবাসী মনোজ যাদবের অভিযোগ, ওপারে ফসল ফলালেই ওরা কেটে নিয়ে চলে যায়। গদাইচরে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প আছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ থাকে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে আসে ওই জলদস্যুরা। গদাইচরে জমি রয়েছে বিমলকৃষ্ণ মণ্ডল, আবদুল রউফদের। তাঁদের কথায়, জমির ফসল লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে 'ঠিয়া পার্টি'র দল। পুলিশ প্রশাসন অবশ্য যথেষ্ট সক্রিয়।
গদাইচরে অস্থায়ী ক্যাম্প করে পাহারার ব্যবস্থাও করেছে পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু রাতের অন্ধকারে আসছে ‘জলদস্যু’রা। ফসল লুঠ আটকাতে গদাই চরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অস্থায়ী ক্যাম্প করে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। পুলিশ প্রশাসন সক্রিয় হয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের দাবি, স্থায়ী ক্যাম্প দরকার। গঙ্গার জেগে ওঠা চরে ফসল লুঠ পুরোপুরি আটকাতে সেখানে পুলিশের থাকার জন্য স্থায়ী জাগয়া, আলো, শৌচাগারের ব্যবস্থা করা দরকার। মহানন্দা টোলার বিশ্বজিৎ ধাওয়ালের দাবি, স্থায়ী প্রহরা হয়ে গেলে ৬০ শতাংশ ফসল লুঠ আটকানো যাবে ঠিয়া পার্টির হাত থেকে। গঙ্গার ওপারে জেগে ওঠা চর। যেখানে বিঘার পর বিঘা চাষের জমি। তারপর সাহেবগঞ্জ রাজমহল পাহাড়। ঝাড়খণ্ডের ওই এলাকা থেকেই আসে দস্যুরা। বিভিন্ন গ্রুপ আছে ওদের। ট্রাক্টর নিয়ে এসে ফসল লুঠ করে নিয়ে চলে যায়, বলছিলেন এক গ্রামবাসী অনিল মণ্ডল। আরেক গ্রামবাসীর কথায়, বিঘা প্রতি দু’হাজার টাকা তোলাও দিতে হয় ঠিয়া পার্টিকে। না হলেই ফসল পাকার পর তা লুঠ করা হবে। মারধরও করে।