সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: তাঁর তাণ্ডব দুরকম। এক তাণ্ডবে মোহিত সকলে। আরেক তাণ্ডবে অনেক সন্ন্যাসীর গাজন নষ্ট হওয়ার জোগাড়। পার্বতী নেই যে সেই তাণ্ডব ঠেকাবে। তাই ভোটের বাজারে কুড়মি প্রার্থী অজিতপ্রসাদ মাহাতোকে ঘিরে যেন ত্রাহিমাম রব। রক্ষা করো মোরে বলে শরণাগত সকলেই!
তিনি নাচেন শিবের তাণ্ডব নৃত্য। এই ৭৪-এও। বয়সের ভারে সেই শক্তিশালী রূপ প্রকাশ না পেলেও তাঁর নৃত্যশৈলী দেখে আনন্দ তাণ্ডব কলাই ফুটে ওঠে। আনন্দের সাথে তিনি এই নাচ অনুশীলন করেন বলেই তাঁর এই আনন্দ তাণ্ডব দেখতে ভিড় জমে যায়। ভোট প্রচারে জনসমক্ষে সেই নাচ না নাচলেও নৃত্যকলার মুদ্রা দেখিয়ে নজর কাড়লেন আদিবাসী কুড়মি সমাজের মূল মানতা (প্রধান নেতা) তথা কুড়মি প্রার্থী অজিতপ্রসাদ মাহাতো। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের কাছ থেকে দীক্ষা নেওয়ার পরই এই নাচ রপ্ত করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ২৭।
সেই সময় থেকেই শিবের তাণ্ডব নাচ নাচছেন তিনি। এই নৃত্যকলার মধ্যে শক্তিশালী বা ধ্বংসাত্মক বিষয় ফুটে উঠলেও ভোট প্রার্থী কিন্তু সেই উগ্রতাকে ফুটিয়ে তোলেন না। তাই তাঁর দু'হাতে থাকে না মাথার খুলি ও তরবারি। তিনি খালি হাতেই এই নাচ নেচে শরীরচর্চা করেন। স্বাস্থ্য ভালো রাখেন। সুস্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে তিনি মাটিতে ঘুমোন। তেল ছাড়া তরকারি খান। ছেলেবেলা থেকেই নিরামিষভোজী। রোজ সকালে হাঁটেন ৫০ মিনিট। হাঁটা শেষে ত্রিফলা চূর্ণ খেয়ে ৪০ মিনিট ধরে যোগাসন। ভোট বাজারে তাঁর এহেন জীবনচর্যাও রাজনৈতিক মহলের মুখে মুখে ফিরছে। ফিরছে ভোটারদেরও।
[আরও পড়ুন: উন্নয়ন স্তব্ধ করতে চাইলে ‘মুখে ঝামা’, সবচেয়ে বড় ব্যবধানে ডায়মন্ড হারবার জয়ের চ্যালেঞ্জ অভিষেকের]
প্রচারের শেষ বেলায় ভোটারদের এই মুদ্রা দেখানোর সময় একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বলছিলেন, "৭৫-৭৬ সাল থেকেই আমি আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের সংস্পর্শে রয়েছি। আমার গ্রাম আড়শার হেঁটগুগুইতে আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীরা তাঁদের কাজকর্মের জন্য অর্থ সংগ্রহে এলে প্রথম তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এরপর তাঁদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি দীক্ষা নিই। সেই সময় আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের কাছ থেকেই এই নাচ শেখা। এই নাচ নিয়মিত নাচলে আর যোগাসন করারও প্রয়োজন হবে না। যদিও আমি ছেলেবেলা থেকেই নিয়মিত যোগাসন করি। এই বয়সে আমি শরীর চর্চা করার জন্যই এই নাচ নেচে থাকি। যাতে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।"
'কালো পাহাড়ের কালো' নেতা অজিতপ্রসাদ মাহাতো। জঙ্গলমহলের ভোট বাজারে এখন তাঁকে ঘিরেই চর্চা সবচেয়ে বেশি। একেবারে কুড়মিদের প্রার্থী ঘোষণার সময় থেকেই। পুরুলিয়া কেন্দ্রে যে ৩৫ শতাংশ কুড়মি ভোট। সঙ্গে হিতমিতান অর্থাৎ সামাজিক সংগঠন। এই ভোট যে পদ্ম বা ঘাসফুলে কোন দিকেই পড়বে না। এই জনজাতির সব ভোট যে যাবে নির্দল প্রতীক বালতিতে! এমনটাই বলছে জেলা রাজনৈতিক মহল। তাই বিজেপির আক্রমণে তিনি 'ভোট কাটুয়া'।
আসলে উনিশের ভোটে এই শাসক বিরোধী কুড়মি ভোট যে পদ্মে পড়েছিল। তাই প্রথম থেকেই বিজেপির উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছেন অজিত। চিন্তায় ঘাসফুলও। এই ৭৪-ও অজিতের প্রতিবাদী, রণংদেহী মেজাজ শুধু নয়। তাঁর অভিনব প্রচার নজর কেড়েছে সমগ্র জঙ্গলমহলেই। হলুদ রঙায় রাঙিয়ে দেওয়া বা প্রখর গ্রীষ্মে এই রঙে অকাল বসন্ত হাজির করা শুধু নয়। মানভূম সংস্কৃতি রক্ষার্থে ভোট প্রচারে কাড়া কে নামানো। কিংবা কাড়ার পিঠে চড়ে মনোনয়ন। সব কিছুই আলাদাভাবে চোখ টানে। আর প্রচারের শেষ লগ্নে তাণ্ডব নৃত্যের মুদ্রা পরিদর্শনেই যেন সকলের মন জিতে নেন।
তবে ভোটের বাজারে এই নাচকে ঘিরে বিতর্কও দানা বেঁধেছে। পুরুলিয়ার প্ৰখ্যাত নৃত্যশিল্পী তথা সিপিএমের সাংস্কৃতিক শাখার কর্মী সুমিত রায় বলেন, "প্রার্থী নৃত্যকলায় পারদর্শী হতেই পারেন। তবে সেই শৈল্পিক গুণটি নির্বাচনের প্রচারে ব্যবহার করা উচিত নয়। কোন কোন ধর্মীয় উপাসনায় নৃত্যের ব্যবহার হয় শুনেছি। তবে তা বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী অনুসৃত নয়।" তবে এই বিতর্ককে সেভাবে আমল দিচ্ছেন না কুড়মি প্রার্থী। কারণ, তাঁর রাজনীতিক, সামাজিক আন্দোলনের কাজে বিতর্ক তাঁকে পিছু ছাড়ে না। বেকারদের কাজের দাবিতে গলা ফাটানো থেকে জঙ্গলমহলকে বৃহত্তর ঝাড়খণ্ড রাজ্যে
অন্তর্ভুক্তিকরনের দাবি। সর্বোপরি আদিবাসী তালিকাভুক্তের দাবিতে সরব।
তাঁর কথায়, "ভোট পেতে কেউ জুতো পালিশ করছেন। কেউ সাবান মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি কাঁচি দিয়ে চুল কেটে দিচ্ছেন। হনুমান চল্লিশা পাঠ করছেন। আমি না হয় ভোটারদের মন পেতে শিবের তাণ্ডব নৃত্যের মুদ্রাই দেখালাম।" পুরাণ অনুযায়ী, মহাদেব তাঁর শিষ্য তন্ডুর মাধ্যমে ভরতমুনিকে তাণ্ডব নৃত্যের শিক্ষা দেন। তাণ্ডবের সাতটি ভাগ। গৌরি তাণ্ডব, উমা তাণ্ডব, সন্ধ্যা তাণ্ডব, কালিকা তাণ্ডব, আনন্দ তাণ্ডব, সংহার তাণ্ডব ও ত্রিপুর তাণ্ডব। নাট্যশাস্ত্র অনুসারে নৃত্যের করণ ও অঙ্গহার সমূহ উদ্ধত ও বৃত্তি আরভটি তাহাই তাণ্ডব। নটরাজ সৃষ্টির আনন্দে যে নৃত্য করেছিলেন তাই হল আনন্দ তাণ্ডব। বীর রসাত্মক নৃত্যে আনন্দের প্রকাশ হয় আনন্দ তাণ্ডবের মাধ্যমে। সেই আনন্দ দানই করছেন ভোটারদের।