একের পর এক সিরিজে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করছেন। মন্দার-এর সুবাদেই বাংলার দর্শকদের অন্দরমহলে আরও পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। এবার রবিনসন স্ট্রিট কান্ড নিয়ে নির্মিত ডকু সিরিজে পার্থ দে-র ভূমিকায় লোকনাথ দে। রিলিজের সময় মুখোমুখি শম্পালী মৌলিক।
এই মুহূর্তে বাংলা সিনেমা এবং সিরিজে আপনাকে মোস্ট ওয়ান্টেড বলা যায়। আপনার অভিনীত শেষ তিনটে রিলিজ ছিল ‘বাদামী হায়নার কবলে’, ‘হুব্বা’ এবং ‘পারিয়া’। নিজেকে অপরিহার্য করে তুললেন কীভাবে?
– আমি তো নিজেকে অপরিহার্য মনেই করছি না। বড় বিব্রত বোধ করছি। কখনও ভাবিনি সিনেমা মাধ্যমে কাজ করব। থিয়েটার করতেই চেয়েছি, সারাজীবন থিয়েটার করব ভেবেছিলাম। লকডাউন-এর পরেই মূল বদলটা আসে। যদিও তার আগে আমি কিছু কাজ করেছি, সেটা আমার থিয়েটারের কাজে বিঘ্ন না ঘটিয়ে। লকডাউনের পরে ‘মন্দার’-এর কাজ করি। সেটা মানুষের ভীষণ ভালো লাগে।
‘মন্দার’-কে কি টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়?
– আগের কাজগুলো অনেকে ভালো বললেও, ‘মন্দার’কে টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়। এই কারণে, যে ‘মন্দার’ সামগ্রিকভাবে এমন একটি প্রযোজনা, যেখানে নির্দিষ্ট কোনও অভিনেতা নয়, বা ডিরেকশন নয়, সামগ্রিকভাবে সিরিজের জগতে, কনটেন্টের নিরিখে ছাপ রেখেছিল। এবং সেটা হইচই-এর মতো প্ল্যাটফর্মে হওয়াতে তার এক্সপোজার বেশি হয়েছে। ফলে মানুষের কাছে বেশি পৌঁছেছে, একটা সামগ্রিক প্রযোজনা হিসেবে দাগ রেখেছে। সেখান থেকেই কাজ পাওয়া শুরু হয়।
তারপরই ক্রমাগত অফার আসতে থাকে আপনার কাছে?
– হ্যাঁ, অফার আসতে থাকে। যেহেতু থিয়েটার করে আমার জীবনযাপন চলছিল, লকডাউনের ফলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আর এদিকে এই ক্যামেরার সামনের কাজগুলো আসতে থাকে যখন, এইগুলোই করতে থাকলাম তখন। ফলে খুব অল্প দিনে বেশ কিছু কাজ করা হয়ে গিয়েছে (হাসি)।
নিউ বারাকপুরেই কি থাকেন এখন?
– আমার আদি বাড়ি হাবড়াতে। নিউ বারাকপুরে এসেছি লকডাউন পরবর্তী সময়ে। মা মারা যাওয়ার পরে এখানে শিফট করেছি।
থিয়েটারকর্মী হিসেবে প্রায় কুড়ি বছরের বেশি সময় কাজ করছেন বলা যায়?
– তার বেশি হবে। ১৯৯৭ সাল থেকেই থিয়েটার করছি। থিয়েটার ওয়ার্কশপেই কুড়ি-বাইশ বছর হয়ে গিয়েছিল।
শুরুটা কেমন?
– হাবড়াতেই আমরা একটা দল তৈরি করেছিলাম, ‘জনজাগরণ’ বলে। সেই দল নিয়ে আমরা বিভিন্ন প্রান্তে কমপিটিশনে গিয়েছি, দেবব্রত দাস তার নির্দেশক ছিলেন। জনজাগরণ-এ বছর তিনেক থাকার পর মনে হয়েছিল, আরও কিছু শেখার দরকার। দলের সঙ্গে একটু মতবিরোধও হয় আমার, থিয়েটার করার দর্শন নিয়ে। সেখান থেকে আবার খুঁজতে খুঁজতে ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ জয়েন করা। সেখানে নোঙর বেঁধেছিলাম কুড়ি বছর। কলকাতায় আসার চেষ্টাও করেছিলাম, কারণ শ্যামবাজারে আমার দল।
থিয়েটার করে যে বিরাট অর্থ রোজগার হত সেই সময় তেমনটা তো নয়। তবু নিজের ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কীভাবে?
– আসলে জীবনে খুব বেশি চাহিদা আমার ছিল না। ছোট্ট বৃত্তেই থাকতে চেয়েছিলাম। জেনে-বুঝেই এসেছিলাম যে, থিয়েটার আমাকে খুব বেশি কিছু দেবে না। টুকটাক অসুবিধে হয়েছিল। কখনও টিউশান করে, যাত্রা করে, বা মিনার্ভা রেপার্টরিতে চাকরি করে টিকে গিয়েছিলাম। তবে থিয়েটারের অভিনয়ের মধ্যেই থাকতে চেয়েছিলাম।
আজকে দাঁড়িয়ে তো আপনার জীবনটা প্রায় বদলে গিয়েছে।
– বদলে গিয়েছে বলে আমার খুব একটা মনে হয় না। আমি যেমনভাবে আড্ডা মারতাম, তেমনই করি। তবে জীবন বদলে না গেলেও, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সে কিছুটা বদল এসেছে, এটা ঠিকই। মানে রোজগারের দিক থেকে একটা সাসটেনেবল জায়গায় এসেছে। জীবনে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন মনে করছি না।
রাস্তাঘাটে নিশ্চয়ই লোকে চিনতে পারছে? এখনও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন?
– হ্যাঁ, খুবই চিনতে পারে। যখন থিয়েটারের রিহার্সালে যাই, চেষ্টা করি ট্রেন-মেট্রোয় যাওয়ার। শুটিংয়ে গেলে করি না। প্রোডাকশন থেকে গাড়ি পাঠায়। আর শুটিংয়ের কনসেনট্রেশনে কাজে লাগে, ওই গাড়িতে থাকার সময়টা।
[আরও পড়ুন: শাহরুখের কাছে রাজনৈতিক পরামর্শের খোঁজে রাহুল গান্ধী, কী উপদেশ বাদশার?]
পাবলিক ট্রান্সপোর্টে লোকজন চিনতে পেরে এগিয়ে আসে না ছবি তুলতে?
– চেষ্টা করি মাস্ক আর টুপি পরতে, তাও চিনতে পারে। এইসব খুব স্বাভাবিক ঘটনা। টেলিভিশনে বা সিনেমায় আমরা যদি মুখ দেখাই এই ভালোবাসা, ঝক্কি বা আবেগ ফেস করতে হয়। সেটা আমরা যেমন কমবয়সে করতাম, আরে বাবা কী লোক! সৌমিত্রবাবুকে প্রথম স্টেজে দেখে আমারই তেমন হত! সব্যসাচী চক্রবর্তীকে দেখেও তেমন হত, পরে কাজ করতে গিয়ে শ্রদ্ধার জায়গা, সখ্যর জায়গা তৈরি হয়। কাজেই উল্টোদিকের মানুষের একটা আবেগ থাকেই। থিয়েটারের থেকে চলচ্চিত্রের জগতের গ্ল্যামার অন্যরকম। কারণটা বুঝি না, কিন্তু হয়।
কিছুদিন আগে আপনি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘টেক্কা’-র কাজ শেষ করেছেন। তাই না? এর আগে বোধহয় ‘পদাতিক’-এ আপনার করার কথা ছিল।
– ওটা কিছুই না, সৃজিত মুখোপাধ্যায় একদিন ফোনে বলেছিলেন– মৃণাল সেনকে নিয়ে সিরিজ করছেন। আমার কথা ভেবেছেন। অনির্বাণ-ই (ভট্টাচার্য) আমার কথা ওঁকে বলেছিল। আমি ভিডিও করে পাঠিয়েছিলাম। উনি ‘ওকে’ বলেছিলেন। আমি বইপত্র পড়তে শুরু করি। তারপরে ‘হাওয়া’ মুক্তি পায় এখানে। এবং চঞ্চল চৌধুরির বিরাট হাওয়া তৈরি হয় এখানে, ততদিনে সিরিজ বদলে সিনেমা হয়ে যায়। ফলে তার লজিস্টিকস, বিপণন ইত্যাদি পাল্টে যায়। তখন চঞ্চল চৌধুরি করবেন ঠিক হয়। সেটা নিয়ে আমার কোনও হতাশা নেই। এর আগেও ঋত্বিক ঘটকের চরিত্রে করার কথা হয়েছিল, কমলেশ্বরদার ছবিতে। কিন্তু মিনার্ভায় চাকরির কারণে আমি করতে পারিনি। পরে পুরো বিষয়টা জেনেছিলাম। ‘টেক্কা’য় আমি পুলিশের চরিত্রে করেছি। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আবার কাজ করতে চাই, যেটা আমাকে আরও ইনপুটস দেবে।
রবিনসন স্ট্রিট কান্ড নিয়ে নির্মিত ডকু সিরিজে আপনি পার্থ দে-র ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। যেটা এই সপ্তাহেই আসবে হইচই-তে। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?
– কমলেশ্বরদা আমার খুব শ্রদ্ধার নির্দেশক, যদিও প্রথমে ওঁকে অভিনেতা হিসেবে চিনতাম। এই ডকু ফিকশনটা একমাত্রিক কাজ নয়। সামাজিকভাবে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পার্থ দে-কে নিয়ে একরৈখিক ভাবনা ছিল মানুষের, তাকে তো বিকারগ্রস্তই বোঝানো হয়েছে। সেখান থেকে একটা উত্তরণের সম্ভাবনা আছে এই ডকুফিকশনে।
আর কী কাজ আসবে?
– ‘পরিণীতা’ বলে একটা সিরিজে কাজ করেছি, ‘অ্যাডভোকেট অচিন্ত্য আইচ’ আসবে। ‘রিস্কি রোমিও’ বলে একটা হিন্দি ছবিতে একদিনের কাজ করেছি। ‘আমার বস’-এ একটা তিন লাইনের পার্ট করে এলাম। আর ‘অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ’, ‘গাজনের ধুলোবালি’ ছবি দুটোও বেরনোর কথা আছে।
[আরও পড়ুন: রাজনীতিতে রামগোপাল ভার্মা, কোন দলের হয়ে ভোটে দাঁড়াচ্ছেন পরিচালক?]
চরিত্রাভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। লিড রোলে করতে ইচ্ছে করে না?
– আমার জীবনচর্চা অন্যরকম। দীর্ঘদিন তো থিয়েটার করছি, থিয়েটারে লিড বলে বা বড় রোল কিছু নেই। সেটা মাথায় গেঁথে আছে। তিন লাইনের পার্টও করেছি, আবার ‘হুব্বা’য় ‘বোকারো বাপি’-ও করেছি। তবে কোনও কিছুর জন্য আমি দৌড়তে পারব না। তেমন চরিত্র পেলে নিশ্চয়ই করব।