shono
Advertisement

Breaking News

মাঠের মানুষ, মাটির মানুষ

নরেন্দ্র মোদির কলমে কিসান বৈজ্ঞানিক’ এম. এস. স্বামীনাথন।
Posted: 08:40 AM Oct 07, 2023Updated: 08:40 AM Oct 07, 2023

সদ‌্য প্রয়াত হয়েছেন অধ‌্যাপক এম. এস. স্বামীনাথন। অনেকে তাঁকে ‘কৃষি বৈজ্ঞানিক’ বলে থাকেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তিনি ছিলেন আরও বেশি কিছু- ‘কিসান বৈজ্ঞানিক’। তাঁর মনন এবং চিন্তনে ছিল কৃষিজীবীর অস্তিত্ব। কলমে নরেন্দ্র মোদি

Advertisement

তামিল ধ্রুপদী সাহিত্য ‘কুরাল’ অনুসারে কৃষকরা বিশ্বের ধারক, কারণ তাঁরা রয়েছেন সর্বত্র। প্রফেসর স্বামীনাথন এই নীতিটি বুঝতেন তো বটেই, বিশ্বাসও করতেন অন্তর থেকে। ক্ষুদ্র কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং উদ্ভাবনার সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে প্রফেসর স্বামীনাথন যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তার কথা উল্লেখ করতেই হয়। মহিলা কৃষিজীবীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গিয়েছেন তিনি।

কয়েক দিন আগেই আমরা হারিয়েছি অধ‌্যাপক এম. এস. স্বামীনাথনকে। চলে গেলেন এমন একজন, যিনি কৃষিবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছেন, দেশের বিকাশে যাঁর অবদান সবসময় লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। প্রফেসর স্বামীনাথন দেশকে ভালবাসতেন, চাইতেন ভারতের মানুষ, বিশেষত কৃষকরা সমৃদ্ধ জীবনযাপন করুন। বিদ্বান, পণ্ডিত, কৃতী এই মানুষটি চাইলে যে কোনও পেশাই বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু বাংলায় ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ তাঁকে এতটাই মর্মাহত ও প্রভাবিত করে যে তিনি ঠিক করে ফেলেন কাজ করবেন কৃষিক্ষেত্র নিয়েই।

বেশ অল্প বয়সে তিনি ড. নরম্যান বোরলগের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর কাজকর্ম বিশদে প্রত্যক্ষ করেন। ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষকতার কাজ পেয়েও ছেড়ে দেন ড. স্বামীনাথন। কারণ ও উদ্দেশ‌্য একটাই: ভারতে থেকেই ভারতের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন তিনি।

[আরও পড়ুন: সাংবাদিকরা আক্রান্ত হলে নড়বড়ে হয়ে ওঠে সত্যি-মিথ্যের ভেদরেখা]

চরম সংকটের মধ্যে থাকা দেশকে তিনি যেভাবে স্বনির্ভরতা এবং আত্মবিশ্বাসের দিশায় পথ দেখিয়েছেন, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তা একবার ভেবে দেখুন। স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশক দেশের তৈরি হওয়া বৃহৎ সমস্যাগুলির মধ্যে অন‌্যতম ছিল খাদ্য ঘাটতি। ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে দুর্ভিক্ষের করাল ভ্রুকুটির মুখোমুখি হয় দেশ। ঠিক তখনই প্রফেসর স্বামীনাথনের দৃঢ় প্রত্যয়, দায়বদ্ধতা এবং দূরদর্শিতা দেশকে কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করে। তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা সামগ্রিকভাবে কৃষিক্ষেত্র, বিশেষত গম উৎপাদনের প্রশ্নে দেশকে দারুণ সাফল‌্য এনে দেয়। খাদ্য ঘাটতি-র দেশ থেকে এক্ষেত্রে স্বনির্ভর দেশ হয়ে ওঠে ভারত। স্বাভাবিকভাবেই ‘ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক’ বলে চিহ্নিত হন তিনি।

‘সবুজ বিপ্লব’ ভারতের ‘সফল হব-ই’ মনোভাবকে তুলে ধরে- অর্থাৎ, সামনে যদি অনন্ত সমস্যা এসে উপস্থিত হয়, তবে তার মোকাবিলার জন্য আমাদের কাছেও রয়েছে উদ্ভাবনী শক্তিতে সমৃদ্ধ অগণিত মনন। সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার পাঁচ দশক পর ভারতীয় কৃষি আরও আধুনিক ও প্রগতিশীল হয়ে উঠেছে। তবে এর মূল ভিত্তি গড়ে দিয়ে গিয়েছেন প্রফেসর স্বামীনাথন- একথা কখনই ভোলার নয়।

বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি আলু চাষে পরজীবী প্রজাতির নেতিবাচক প্রভাবজনিত সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেন। শীতল আবহাওয়াতেও কীভাবে আলুচাষ ও শস‌্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব তার পথ বাতলে দিয়েছে তঁার গবেষণা। সারা বিশ্ব এখন মিলেট বা শ্রীঅন্নকে ‘সুপার ফুড’ হিসাবে দেখছে। কিন্তু এ নিয়ে গবেষণা ও আলোচনার প্রসারে প্রফেসর স্বামীনাথন উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন সেই নয়ের দশক থেকেই।

প্রফেসর স্বামীনাথনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বহু দিনের। ২০০১-এ আমি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় থেকেই তার সূচনা। ওই সময়ে কৃষিক্ষেত্রে গুজরাত অগ্রবর্তী রাজ্য হিসাবে তেমন পরিচিত ছিল না। একের-পর-এক খরা, সুপার সাইক্লোন এবং একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প রাজ্যটির বিকাশের পথে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। পরিস্থিতির মোকাবিলায় আমরা যেসব উদ্যোগ নিই তার মধ্যে একটি ছিল ‘সয়েল হেল্‌থ কার্ড’- যা মাটির চরিত্র আরও ভালভাবে বোঝা এবং কোনও সমস্যা এলে আরও ভালওভাবে তার মোকাবিলা করার পক্ষে সহায়ক। ওই সময়ে প্রফেসর স্বামীনাথনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি উল্লিখিত প্রকল্পটির প্রশংসা করেন এবং মূল্যবান মতামত দেন। তাঁর এই প্রশংসা প্রকল্পটি সম্পর্কে সন্দিহানদের মুখ বন্ধ করে। কৃষিক্ষেত্রে গুজরাতের সাফল্যের ভিত তৈরি হয়।

আমি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও প্রফেসর স্বামীনাথনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ২০১৬-য় আন্তর্জাতিক ‘কৃষি-জীববৈচিত্র কংগ্রেস’-এ তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। ২০১৭-য় দুই খণ্ডে তঁার লেখা একটি একটি বই প্রকাশ করি আমি।

তামিল ধ্রুপদী সাহিত্য ‘কুরাল’ অনুসারে কৃষকরা বিশ্বের ধারক, কারণ, তাঁরা রয়েছেন সর্বত্র। প্রফেসর স্বামীনাথন এই নীতিটি বুঝতেন তো বটেই, বিশ্বাসও করতেন অন্তর থেকে। অনেকে তাঁকে ‘কৃষি বৈজ্ঞানিক’ বলে থাকেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তিনি ছিলেন আরও বেশি কিছু- ‘কিসান বৈজ্ঞানিক’। তাঁর মনন এবং চিন্তনে ছিল কৃষিজীবীর অস্তিত্ব। ডা. স্বামীনাথনের সাফল্য অবশ্যই লেখাপড়ার জগতে সীমাবদ্ধ নয়। তার প্রভাব পরিব্যাপ্ত পরীক্ষাগার পেরিয়ে খেতে-খামারে। তিনি বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং তার বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে এনেছিলেন। ক্রমাগত তিনি ধারাবাহিক কৃষির উপর জোর দিয়ে গিয়েছেন- যা মানুষের অগ্রগতি এবং বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্যকে তুলে ধরে। ক্ষুদ্র কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং উদ্ভাবনার সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে প্রফেসর স্বামীনাথন যে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তার কথা উল্লেখ করতেই হয়। মহিলা কৃষিজীবীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গিয়েছেন তিনি।

প্রফেসর স্বামীনাথনের ব্যক্তিত্বের আর-একটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি উদ্ভাবনা এবং পরামর্শ ও উৎসাহদানের প্রশ্নে ছিলেন ক্লান্তিহীন। ১৯৮৭ সালে ‘বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার’-এর প্রথম প্রাপক হিসাবে পাওয়া অর্থ তিনি একটি অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে লাগান। আজও ওই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে চলেছে। একের পর এক প্রতিভাবানকে তিনি আরও শিখতে, নতুন কিছু করে দেখানোয় উৎসাহিত করে গিয়েছেন অক্লান্তভাবে। প্রতিষ্ঠান নির্মাতা হিসাবেও তাঁর অবদান ভোলার নয়। ম‌্যানিলা-র আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা হিসাবে কাজ করেছেন। ২০১৮-য় বারাণসীতে তৈরি হয় ওই প্রতিষ্ঠানের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক কেন্দ্র।

ড. স্বামীনাথনের প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘ নিবেদনে আমি আবার ‘কুরাল’-এর শরণাপন্ন হতে চাই। সেখানে লেখা আছে ‘যাঁরা পরিকল্পনা করেন, তাঁরা যদি স্থিতপ্রজ্ঞ হন, তবে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত উপায়ে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে সফল হবেনই।’

ড. স্বামীনাথন প্রথম জীবনেই কৃষি এবং কৃষকদের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেকাজ তিনি করেছেন অনন্য উদ্ভাবনী শক্তি এবং ভালবাসাকে পাথেয় করে। কৃষিক্ষেত্রে উদ্ভাবনা ও ধারাবাহিকতার দিশায় এগতে তিনি আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। যে-নীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন তার প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে আমাদের। কৃষকদের কল্যাণে ব্রতী হওয়া, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনার সুফল কৃষি জগতের তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়া, ধারাবাহিক বিকাশের প্রশ্নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং আগামী প্রজন্মের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করায় সচেষ্ট থাকলে তবেই তা সম্ভব।

[আরও পড়ুন: পূজারি যোগ্য হলে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর একত্র আরাধনা সম্ভব, প্রমাণ করেছিলেন বিদ্যাসাগর]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement